বহু জাতি, ভাষা আর সংস্কৃতি এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। আমেরিকার প্রতিদিনের গল্প যেন অভিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার গল্প। নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া ঋদ্ধ ঔপন্যাসিক সাজ্জাদ আলীর সুনিপুণ লেখনীতে বুনে তোলা জীবনের অন্তর্গত গল্পের এক নিটোল প্রেমের উপন্যাস। গ্লোরিয়া আর ফিরোজের অভিবাসী জীবন উদ্যাপনের জীবন্ত ক্যানভাস স্পন্দিত হয়েছে এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।
"নির্বাচিত কবিতা" ফ্ল্যাপে লেখা কথা: "শামস আল মমীনের 'লি শেন' কবিতাটি পড়ে কেন যেন আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল ছুটে যাই লি শেনের কাছে যে একা, বিচ্ছিন্ন বাবা বা মায়ের কাঙাল, যার অন্তরের কান্না প্রতিমুহূর্তে বড় হচ্ছে, বিশাল হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, আফ্রিকায়, পৃথিবীর দেশে দেশে"- বলেছেন কবি মতিন বৈরাগী। মমীনের কবিতা সহজেই ছুঁয়ে যায় মানুষ, প্রকৃতি ও নিসর্গ। তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন: 'তোমাদের জন্য রেখে যাব ভরা নদী, খালবিল নদী ও হাওরের কিলবিল মাছ রেখে যাব শস্যক্ষেত ধনেপাতার নরম গন্ধ' তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, 'সকল বিশ্লেষণ স্থগিত রেখে তাকে শুদ্ধ কবি বলাই আমি সঙ্গত মনে করি। মাত্র গোটা ছয় কবিতার বই লিখিয়াছেন মমীন। তাহাতেই তাহাঁর স্বরলিপি শিলালিপি হইয়া উঠিয়াছে। মমীনের কবিতায় বাংলাদেশের নতুন কথা আছে। আর আছে উত্তর আমেরিকার পুরানা ছবিও। এই অভিজ্ঞতার কিয়দংশ তিনি বাংলা কবিতায় যোগ করিতেছেন। ইহাতে বাংলা কবিতায় একপ্রকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করিয়াছেন তিনি। 'নির্বাচিত কবিতা' তারই সত্য উদাহরণ।
এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে কেহই চির অমর নয়। মহান আল্লাহর বেঁধে দেয়া একটা নির্দিষ্ট আয়ু নিয়ে আমাদের সকলেরই পৃথিবীতে ক্ষণীকের ত্বরে আগমন। ক্ষণস্কালের এই আয় নিয়ে আমাদের সকলের জীবনই একই সমান্তরাল রেখায় প্রবাহিত হয়না। এই পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষকেই অনেক সংগ্রাম করে কষ্ট করে জীবন নির্বাহ করতে হয়। তাদের জীবনে সুখ চিরকাল অধরাই হয়ে থাকে। প্রকৃত নির্মল সুখ বলতে যা বোঝায় তা শতকরা ২/১ জনের ভাগ্যেই কিঞ্চিত জোটে। অথচ একটুখানি সুখের জন্য মানুষকে কতইনা পরিশ্রম করতে হয়। আলোচ্য 'নীলার ভালবাসা নিউইয়র্ক' গল্পের নীলা একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী তরুণী। তার জীবনটা তো অনেক সুখেই অতিবাহিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, অন্য আর দশজনের মতো তার জীবনেও বারবার নেমে এসেছে, কালিমার অমানিশা। আসলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বদলাবার সাধ্য কারও হাতে থাকে না। উপরওয়ালার ইচ্ছা আর অনেক সময় চারিত্রিক হীনমন্যতা ও নানা লোভ লালসাই আমাদের আলোর পথ থেকে নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। মানুষ যা চায়, সেটা সে সহজে পায়না। অথচ যেটা চায়না, সেটাই অবলীলাক্রমে জীবনে এসে যায়। আর এটা নিয়তির নির্মম ও নিষ্ঠুর খেলা। নীলার মা-বাবাও চেয়েছিল, নীলার সারাটি জীবন যেন অনাবিল সুখের আলোয় ভরা থাকে। কিন্তু ভাগ্যের লীলা কি কখনও খণ্ডানো যায়? সহজ উত্তর, ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই। তবে নিরলস ও সৎ পরিশ্রম থাকলে কিছুটা সুখ অবশ্য পাওয়া যায়।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস আগেই জানা ছিল। তাই সকাল থেকে আকাশ গোমট দেখে আশ্চর্য হয়নি সে। সাদা ছেঁড়া কাগজের মতো কিংবা পালকের মতো তুষার ঝরতে শুরু করেছিল অবশ্য এর পর পরই। বিশাল জানালার পাশে বসলে বাহিরটা পরিষ্কার দেখা যায়। মতিন শব্দহীন বসেছিল। এরকম তুষার ঝরার সময়ে তার মন কেন জানি এখনো বিষণ্ণ হয়ে যায়। মেঘলা দিন কিংবা বৃষ্টির দুপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। কালো কালো বিশাল মেঘের দল দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ে যেত। কখনো কখনো হঠাৎ ঝমঝম করে ঝরে পড়ত তাদের চৌচালা টিনের ঘরের চালে। সুপারি ও নারকেল গাছগুলো নীরবে-নিঃশব্দে উপভোগ্য ভঙ্গিতে শুধু ভিজে যেত। এ বছর একটু দেরিতেই বরফ পড়ছে। অন্যান্য রাজ্যে আগেই পড়েছে। নিউইয়র্কে আজই প্রথম। ধীরে ধীরে পাতলা একটি আস্তরণের মতো তুষার জমছে রাস্তায়। সে জানে দিনের শেষে এগুলোই চার থেকে পাঁচ ইঞ্চিতে দাঁড়াবে। শেষের দিকে বৃষ্টিও হতে পারে। এরকমই বলেছে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে। এ দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথার্থই হয়ে থাকে।
দীঘদিন জীবনযাপন পশ্চিমে। কত সব লেখা, বই, পড়া, কতসব সিনেমা, থিয়েটার নাটক দেখা, কতসব টেলিভিশনের রাতজাগা প্রোগ্রামে নিদ্রাহীন। এইসব দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে কতসব লেখালিখির মানুষের কথা জানা। জেনে চুপ করে বসে থাকবেন তাই কি হয়। সেসব নিয়ে লেখালেখি। সিলভিয়া প্লাথ, ডিলোন টমাস, ডিকেন্স, মার্ক ডি সাদ, জেফানাইয়া, ভ্যান গফ, গঁগা আরো কত কে। মনে কত প্রশ্ন। – কেন কান কাটলেন ভ্যান গফ, কেন তাহিতিতে পালানের গাঁগা, কেন ডিকেন্সকে দেখা দিলেন না প্রথম প্রেম বৃদ্ধা মারিয়া বিডনেল, কেন জন ফাাওলস নোবেল পেলেন না, কেন বিয়ট্রিক্স পটার সারাজীবন নরম্যান ওয়েনের আংটি পরে রইলেন, স্বামী তাঁকে সে আংটি খুলতে দিলেন না? কেন কেটলিন ম্যাকনামারা সুখ খুঁজে পেলেন একজন সাধারণ মানুষে ডিলোন টমাসে নয়। ভিভিয়েন হে উড কেন কাটালেন জীবনের অনেকগুলে বছর পাগলা গারদে একা? এমনি সব অসংখ্য প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজা। যে দেশে জলভরা মেঘ আর হঠাৎ নামা ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। সেগুলো ছাপা হলো নানা জায়গায়। দেশের ও বিদেশের পত্রপত্রিকায়। সেগুলো কুড়িয়ে দেখলেন পরিমান একমুঠো। সেগুলো মালার মত গেঁথে রচনা করলেন একটি বই। সুহ্রদ উদয় শংকর দূর্জয় সেগুলো পাঠিয়ে দিল ঢাকার অনুপ্রাণন প্রকাশনীতে। যেখান থেকে ওর দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার সেইসব লেখা এবার দুই মলাটে বন্দী হবে। একটি বই হবে। ভাবতেও আনন্দ। চলুন পাঠক লন্ডনের বৃষ্টিভেজা ঘাসের মাঠে একবার। দেখা যাক কি আছে সেখানে। এলিয়টের ভাষায় বলি- লেটস গো দেয়ার দেন ইউ এ্যান্ড আই।
দেশ ও বিদেশের পটভূমিতে বিভক্ত বাংলাদেশের মানুষের এক অন্তরঙ্গ আখ্যান পুরুষ উপন্যাসটি। এর একদিকে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের জটিল বাস্তবতা; অন্য দিকে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশের মানুষের যাপিত জীবনের সংগ্রামী ইতিবৃত্ত। এক অর্থে পুরুষ দুই বন্ধু নিজাম কাজমী ও কফিলউদ্দিন চৌধুরীর বিনুনীর মতো পেঁচিয়ে থাকা জীবনেরই কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় দুই বন্ধুতে যেখানে ইশারায় আশ্বাসে আর বাঁচার গানে ছিল মোগ্রস্ত সেখানে যুদ্ধোত্তর কাল যেন তাদের ভাসিয়ে নিল জীবনেরই ভিন্নতর প্রবাহে। যুদ্ধোত্তর কালের পরিবর্তনের জটিলতা গভীর ছায়া ফেলেছে তাদের দুজনেরই জীবনে। প্রবাসে বাস করলেও দেশপ্রেম সব সময় থেকেছে অন্তঃশীল। জীবনের বাঁকে বাঁকে দুজনের হৃদয়েই রয়ে যায় সেই বাংলাদেশ-এক দিকে যার বিকাশ আর অন্যদিকে যাতনা। সব মিলিয়ে এ-ই যেন তাদের প্রবাস জীবন। উপন্যাসের আখ্যানে এক জনের স্থিতি আর অন্যজনে অস্থিরতার মধ্যেই লেখকের অন্বেষণ দেখা যায় কাক্ষিতের: পীর, মল্লিকা, জ্যাক ড্যানিয়েল গ্রাস করে একজনকে, অন্য জন অচেতন অনুভবলোক থেকে খোঁজেন অন্বিষ্ট বোধকে। জীবন্মতের অবচেতনতা থেকে জেগে-ওঠা আশা এবং দুটি খুনের মতো নাটকীয় নেতিবাচক ঘটনার আড়ালে পুরুষ উপন্যাসটি উত্তীর্ণ হয়ে ওঠে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। কী সেই ব্যঞ্জনা তা অনুভব করতে হলে পড়তে পড়তে এর শেষে পৌঁছতে হবে পাঠককে।
শিক্ষা এবং সাহিত্য আধার আধেয় উভয় বৈশিষ্ট্যেই স্বতন্ত্র। শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা প্রসঙ্গে মনীষীদের ভাবনাসহ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্ভাব্য সকল দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে এ গ্রন্থের 'শিক্ষা অংশে। ইংরেজি শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ইতিবাচক দিক, ইংরেজি শিক্ষাদানে রবীন্দ্রনাথের সরলীকৃত পদ্ধতি এবং জীবনানন্দ দাশের যুগোপযোগী শিক্ষাচিন্তার শিল্পসম্মত মেলবন্ধন ঘটেছে এতে। অগোচরে পড়ে থাকা মেধাবী কথাকার সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল ও লোকনাথ ভট্টাচার্যের সাহিত্যকর্মের সযত্ন পরিচর্যা; উপন্যাসের কথক প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিকের ভাবনা; সতীনাথ ভাদুড়ী, মিরজা আবদুল হাই, আহমদ ছফা এবং বিজন শর্মার প্রতিনিধিত্বশীল উপন্যাসের বিশ্লেষণ; এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটে বাংলা সাহিত্যের দুরবস্থার অন্বেষণ এ গ্রন্থের সাহিত্য অংশের আলোচ্য। সর্বশেষ প্রবন্ধটি অনলাইনে বাংলাদেশের সাহিত্যের দারিদ্র্য দূরীকরণে লেখকের ব্যক্তিগত পদক্ষেপের খতিয়ানে হয়ে উঠেছে সমুজ্জ্বল।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে সাথেই অসংখ্য বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে পৃথিবীর দূর-দূরান্তে। জীবিকা, প্রাচুর্য আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের মোহিনী হাতছানিতে যেন তীর্থযাত্রার দুঃখ, ক্লান্তি, বিপদ, এমন কি প্রাণ সংহার সবকিছু ভুলে গিয়ে তারা হয়েছে ভিনদেশে পরবাসী। প্রশ্ন হলোঃ এই ভিনদেশ কি প্রার্থিত আনন্দধাম? নাকি দুঃসহ কারাগার? প্রার্থিত নির্বাসনে অপার প্রাচুর্য এবং নিরন্তর কর্মপ্রবাহের মাঝেও ফেলে আসা মাতৃভূমির স্মৃতি অনুভূতির দিগন্তে থাকে ভাস্বর। থাকে চৈতন্যের জ্যোতিষ্কে দীপ্তিমান। দূর-দূরান্ত থেকে কখনও বাংলাদেশকে মনে হয় যেন "নষ্ট পোকার অবিন্যস্ত ঢিবি"। কখনও আবার মনে হয় অতিপৃথিবীতে জেগে ওঠা এক মায়াবী রমণী। ভালবাসা, ক্রোধ, অভিমান, সুখ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা, হারানো স্মৃতি সব মিলে প্রবাসের এই অনুপম দৃশ্যকল্প এক অনবদ্য রূপকে এবং উপমায় উদ্ভাসিত হয়েছে ড. মোস্তফা সারওয়ার-এর কাব্যগ্রন্থ প্রার্থিত নির্বাসনের উন্মাদ পদাবলী-তে।
আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিসংগ্রামের নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধার। মনােভাব নিয়ে গড়ে উঠুক, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু। মানবতার শত্রু রাজাকার আলবদরদের প্রতি। ঘৃণা ও ধিক্কারে নিজেদের শাণিত করুক, সকল আগ্রাসন ও নাশকতা থেকে আমাদের কষ্টলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হােক-এই লক্ষ্য নিয়েই আমার এই লেখা।। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত হয়েছে এই বইয়ের। তথ্যাবলী। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত। ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি’র ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ নৌ-কমান্ডাে এসােসিয়েশনের মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডাে স্মরনিকা '৯৫ আমার ‘একাত্তর কথা বলে এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আরাে বেশ কিছু বইপত্র রয়েছে। বইটি প্রকাশের জন্য অন্বয় প্রকাশের পক্ষ থেকে। শিশুসাহিত্যিক হুমায়ুন কবীর ঢালী এগিয়ে। আসায় তাকে ধন্যবাদ। পাঠক মহল বইটি কিভাবে নেবেন এখন সেদিকেই চেয়ে রইলাম। যদি কোনাে প্রশ্ন ওঠে, যদি কোনাে বিতর্ক দেখা দেয়, আমি তাকে স্বাগত জানাব।
বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গরসাত্মক লেখকের সংখ্যা বেশি নয়। রঙ্গরসাত্মক রচনার মধ্য দিয়ে বিপুল খ্যাতি লাভ করেছিলেন যে কজন লেখক, তাদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। রঙ্গব্যঙ্গ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু রসই উপস্থাপন করেননি, দেশ ও সমাজের অসংগতিগুলােও তুলে ধরেছেন আর আঘাত করেছেন আমাদের অনৈতিক ও আপসকামী মনকে। ফুড কনফারেন্স গল্পগ্রন্থটি প্রকাশের পর আমাদের সাহিত্যজগতে আলােড়নের সৃষ্টি হয়। এ বইয়ের গল্পগুলােতে বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংঘটিত ঘটনার চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে রঙ্গব্যঙ্গের সরসতায় ।হাস্যরসের অন্তরালে নিহিত কঠোর সমাজবাস্তবতা আজও পাঠককে গভীরভাবে ভাবিয়ে তােলে। লেখক প্রায় আশি বছর আগের নানা অসংগতিকে কেন্দ্র করে রসের চাবুকে যে আঘাত হেনেছিলেন, বর্তমানে পাঠক সেই আঘাতের প্রয়ােজনীতা আরও বেশি করে অনুভব করবেন।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি মেয়ে জেবুন্নেসা এই উপন্যাসে পাঠকের সামনে মেলে ধরে তার জীবনের একটা দিন স্মৃতি, স্বপ্ন, অনুভ‚তি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং চারপাশের ছবি বুনতে বুনতে সে কথা বলে। গল্পের মঞ্চ মেলবোর্ন শহর ও সন্নিহিত সাবআরবান এলাকা জুড়ে। মেলবোর্নে এসে হোঁচট খাওয়া, বন্ধুত্ব, চাকরি ইত্যাদির পাশাপাশি সাহিত্যপাঠ তাকে সন্ধান দেয় নতুন এক দুনিয়ার। তার তীব্র প্রেম, শূন্যতা, অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির গল্প শোনায় সে। বইবাহিক মূলত পথচলার কাহিনি চলার পথে খুঁজে পাওয়া এবং চলতে চলতে হারিয়ে ফেলার গল্প।
আপাতদৃষ্টিতে বংশবীজ একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস হলেও এর ব্যাপ্তি গভীরতা বহুমাত্রিক। এ উপন্যাস সিলেটের বর্ণময় নানান চরিত্রসম্পন্ন সম্রান্ত, পরিশীলিত এবং রুচিবান একটি বৃহৎ পরিবারের গল্প। আবার তা বিলেতে সিলেটবাসীদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগত অভিবাসনের প্রেক্ষিতে উপযুক্ত পরিবারের নানান সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে বিলেত যাত্রা ও প্রতিষ্ঠা লাভের আলেখ্যও। এবং এ গ্রন্থকে এও বলা যেতে পারে, এখন থেকে তিন দশক আগে বাংলাদেশের একজন নারীর দেশের বর্ণাঢ্য ও প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী জীবন ও লেখার জগৎকে পেছনে ফেলে বিলেতে নিজেকে প্রতিষ্ঠার উপাখ্যান। আর এই অভাবনীয় আলেখ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন বাংলাভাষার এক কবি ও লেখকের বিলেতে মূলধারা ইংরেজি সাহিত্যে নিজেকে কবি ও লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অদম্য স্পৃহা ও নিরন্তর প্রচেষ্টার ও সমান্তরালভাবে বাংলা সাহিত্যেও নিজের সৃষ্টিকে বেগবান রাখার গল্প। কবি ও লেখক শামীম আজাদ ঈর্ষণীয় কৌশলের সঙ্গে এরকম বহুমাত্রিকতাকে একটি অবিচ্ছিন্ন। কথনকাঠামোর মধ্যে সুগ্রথিত করেছেন। তাঁর নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক গল্প এতে যেমন আছে, তেমনি আছে তার চোখে বিভিন্ন সময়ের সামাজিক অবস্থা, বাধা, সংগ্রামের ইতিহাস। এ লেখা তাই একাধারে উপন্যাস এবং তার পাশাপাশি ইতিহাস ও সমাজচিত্রণও বটে। এমন একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থের পাঠ দাবী করে সুগভীর অভিনিবেশ এবং সেটা প্রদত্ত হলেই সেই পাঠ হয়ে ওঠে অনাস্বাদিত সুখপাঠ।
প্রায় তিরিশ বছর আগে শামস মমীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'চিতায় ঝুলন্ত জ্যোৎস্না' প্রকাশিত হওয়ার পর সলিমুল্লাহ খান তাঁকে শনাক্ত করেন এক ভিন্ন স্বরের কবি হিশেবে। তিতাশ চৌধুরী বলেন, তাঁর কবিতা কখনো রোমান্টিক, কখনো বা প্রতিবাদী। মমীন তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে অবশ্য ভিন্ন বাঁক নিয়েছেন। এই বাঁক পরিবর্তনের মাঝেও কোথায় যেন একটি আবৃত্তি রয়ে গেছে তাঁর কবিতায়। সলিমুল্লাহ খানের নবতর বিশ্লেষণে সে কথাই শুনেই পাই: নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা ইতিহাসের উপলব্ধির সহিত মিলাইয়া দিবার ঢের উদাহরণ আছে মমীনের কবিতায়।' একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায় আহমাদ মাযহারের লেখায়। মমীনের কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করে তিনি বলেন, মার্কিনদেশে দীর্ঘ বসবাসের ফলে তাঁর কাব্যাদর্শ ও কাব্যনির্মিতিতে বাংলাদেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা চৈতন্যও যুক্ত হয়েছে সমানভাবে। এ সংকলনে আরো আছে সিকদার আমিনুল হক, মতিন বৈরাগী, আবেদীন কাদের, চঞ্চল আশরাফ, রাজিয়া সুলতানা প্রমুখ কবি ও প্রাবন্ধিকের নানামুখী আলোচনা ও বিশ্লেষণ। এসব রচনা শামস আল মমীনের কবিতা পাঠে অধিকতর সহায়ক হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির দুই পাপ, যা ঠেকাতে সরকারি নীতিনির্ধারকেরা তাত্ত্বিক নিষ্ঠা কিংবা সদিচ্ছার পরিচয় দিতে পারেননি—বিশেষত কোভিড-উত্তর সময়ের বাংলাদেশে। চলমান নীতি আর অনীতির দ্বন্দ্বে অনীতির জয় হয়েছে। সংকটে পড়েছে অর্থনীতি। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত গতি অর্জন করতে পারেনি। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে গিয়ে জাতিকে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। প্রবৃদ্ধিও গেছে নেমে। বাংলাদেশের মতো একটি বিপুল সম্ভাবনাময় আর উন্নয়নমুখী অর্থনীতির জন্য যা শুভ ইঙ্গিতবহ নয়। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের অজুহাত বৈশ্বিক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। বৈশ্বিক বাস্তবতা ও শাস্ত্রীয় অর্থনীতির আলোকে এর প্রতিকার জানতে চাওয়ার আগ্রহ আমাদের জন্য স্বাভাবিক। নীতি-অনীতির এই দ্বন্দ্ব এবং প্রাসঙ্গিক সব প্রশ্ন-উত্তর দিয়ে সাজানো হয়েছে এই বই।
মুঘল অধিকৃত সুবে-বাংলা একনা ছিলো এক স সম্পন্ন জনপদ। এখানকার মানুষগুলির জীবন জুড়ে ড়ে ছিলো নিরবিচ্ছিন্ন প্রশান্তি আর সুখ সমৃদ্ধি। মসলিন নাম নামক মায়াবী তত্ত্বতে যেন গাঁথা ছিলো মানুষগুলি জীবন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র দিল্লি-আত্মার মানুষগুলি যেমন ভালোবাসায় আবেগে অভিভূত হয়েছে, প্রেমের কুহকে দিশেহারা হয়েছে, আবার সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে, তেমনি মুঘলদের সুবেদার শাসিত সুবের মানুষগুলির জীবন আবর্তিত জাগতিক আর মানবিক চালিকা শক্তি দ্বারা। 'বিচলিত সময়' ইতিহাস আশ্রিত একটি আলেখ্য। ইতিহাস আশ্রিত কিন্তু ইতিহাস নয়। ইতিহাস ঘটনা পরস্পরায় খতিয়ান। আর উপন্যাস ঘটনার মোড়কে মানব-মানবীর হৃদয়মথিত চিত্রায়ণ। উপন্যাসটির পটভূমি বিশাল এবং ব্যাপক। আর সেই পটভূমি বাঙ্ময় হয়েছে কয়েকজন মানব-মানবীর পদচারণায়। বিচলিত সময়ের প্রধান চরিত্রগুলি ইতিহাসের মোড়ক উন্মোচন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে লেখকের লেখনির কুশলতায়। ইতিহাসের আলো আঁধারি থেকে উঠে আসা কবি সৈয়দ জাফর, দেবদাসী নর্তকী রশমী, অহম রাজকন্যা নাঙছেন গাভারু, পর্তুগিজ কুঠিয়ালের বাঙালি ঘরণী মারিয়া প্রভৃতি চরিত্রকে যেন আমাদেরই আপনজন বলে মনে হয়। আর নতুন করে পাঠককে নিয়ে যায় আমাদের অনেক চেনা লালবাগ দূর্গ আর পরী বিবির ছায়াচ্ছন্ন দিনগুলিতে। অনুপুঙ্খ বর্ণনা সতেরোশ' শতকের বাঙালি সমাজের চালচিত্র বইটির উপরি পাওনা। সুদূর আমেরিকায় বসে লেখা এই বইটি লেখক আবদুন নূরের মেধা-মননের স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। -ফখরুজ্জামান চৌধুরী