আকাশ নামক এক ছেলে জাপানে পড়তে যায়। পিএইচডি শেষ করে বাংলাদেশে ফেরার জন্য বিমানে চড়ে। বিমানটিতে একটি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। পাইলট চলন্ত অবস্থায় ত্রুটিটিকে ফিক্স করতে চান। বিমানটিতে তেল আছে ৫৫ মিনিটের। বাংলার দুই পাইলট মিলে এই পদ্ধতি ঐ পদ্ধতি চেষ্টা করছেন। বিমানটি নীড় হারা পাখির মতো ঢাকার আকাশে ঘুরছে। সারা দেশ বিমানটির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে প্রার্থনা করছে। ১৯৮ জন যাত্রীর প্রাণ দুই জন পাইলটের হাতে। যারা বিমানের ভেতরে আছেন, তাদের মনে কী অবস্থা, যারা নিচে বসে প্রার্থনা করছেন তাঁদেরই বা কী অবস্থা? জাপানি ভাষায় সোরা মানে আকাশ। আকাশ নিজেকে সোরা বলে ডাকে। সোরার মা সোরার একটা পুরনো গেঞ্জি কামড়ে ধরে বসে আছে। সোরা কি পারবে মায়ের কোলে ফিরতে? নাকি সোরা থাকবে আকাশে, সোরাকাশে।
আশির যখন জাপানে গিয়েছিল, ও তখন ছাত্র। পুরো আলাদা একটা সংস্কৃতি থেকে সেখানে গিয়ে সে দেশের নানা কিছু দেখে ও স্বাভাবিকভাবেই অবাক হয়েছে। বিচিত্র বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত ঢঙে লেখা এই বইয়ের ছোট ছোট রচনাগুলো ওর সেই অবাক হওয়ার গল্প। জাপানি জীবনের নানা ব্যাপার দেখে ও শুধু একাই অবাক হয়েছে তা নয়, ওর স্বাদু চিত্তাকর্ষক আর আমেজি লেখার মৌতাতে পাঠক হিসেবে আমরাও যেমন কিছুটা অবাক হয়েছি। লেখাগুলো ছোট, মজাদার, বুদ্ধিদীপ্ত ও গতিশীল। বিচিত্র তথ্যে ভরা। লেখার এই প্রসাদগুণ দিয়ে আশির ছোট ছোট বেশ কিছু মানবিক গল্পের পাশাপাশি জাপানি জীবনের নানা পরিচয় ওখানকার মানুষের আত্মহত্যা, তাদের ভ,তে ফিউনারেলের পরিপাটি ব্যবস্থা, শ্মশান, কাস্ট সমস্যা, কুসংস্কার, সামাজিক শিক্ষা, ভাষা, মিডিয়া, এমনি হরেক বিষয়কে রমণীয় করে তুলেছে। দেশটিকে ও ট্যুরিস্টদের মতো বাইরে থেকে দেখেনি, দেখেছে একজন বিদেশি হিসেবে, যে বহুদিন সে দেশে থাকতে থাকতে নানা বাস্তব ও মানবিক অভিজ্ঞতায় ভরে উঠেছে। এ বই তারই উষ্ণ-সজীব বিবরণ। এ জন্য বইটিতে জাপানের অন্তর্জীবনের খবর মেলে। ২০০৫ সালে জাপানে বেড়াতে গিয়ে আমি ও দেশের ওপর একটা ভালো বই নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বইটি পড়ে জাপান সম্বন্ধে আমি যতটুকু জেনেছিলাম, আশিরের 'জাপান কাহিনি' পড়ে জাপানকে যেন জেনেছি তার চেয়ে বেশি। এর কারণ, এ গল্প জাপানের একেবারে ভেতরের গল্প। লেখকের ব্যক্তিগত রসবোধ, চাহনি, বর্ণনাভঙ্গি একে প্রাণবন্ত করেছে। বইটি আমাকে জাপানের বাসিন্দা করে তুলেছে। পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি নিজেই দেশটিতে আছি। সব পাঠকের হয়তো তা-ই মনে হবে।
এই পৃথিবীতে অনেক মানুষই এসেছে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে। আর কিছু মানুষ এসেছে ইতিহাসকে বদলে দিতে। সেই কিছু মানুষের একজন বখতিয়ার খলজি। অথচ তার সম্পর্কে কতটুকুই বা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়? যা লেখা আছে, তাও বখতিয়ারের মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে তারই এক সহযোদ্ধার কাছে থেকে শুনে। বৃদ্ধ সেই সহযোদ্ধার বর্ণিত ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন পারস্য দেশীয় ইতিহাসবিদ, মিনহাজ-ই-সিরাজ, তার ‘ত্ববাকত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে। স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতি এবং শ্রুতিনির্ভর ইতিহাসে থাকে অসামঞ্জস্য, থাকে ভুল। থাকে অনিচ্ছাকৃত বর্জন কিংবা প¶পাতদুষ্ট অতিরঞ্জন। থাকে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত ও ধর্মীয় মতবাদের প্রতিফলন। আর সেই কারণেই ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কাছে বখতিয়ার হয়ে উঠেছে এক অন্যতম বিতর্কিত চরিত্রের নাম। প¶ে ও বিপ¶ে হয়েছে প্রচুর বিতর্ক। হয়েছে অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ। আমি ইতিহাসবিদ কিংবা গবেষক নই। সেই সব বিতর্ক ও বিশ্লেষণের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই আমার। আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি সেই উচ্চাভিলাষী বখতিয়ারকে, যে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় আফগানি¯—ান থেকে এসে তৎকালীন মগধ ও গৌড়ের অধিপতি হয়েছিল। আমি দেখার চেষ্টা করেছি সেই অদম্য অশ্বারোহীকে, যে বাংলা ও বিহারে ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিল, আবার উল্কার মতোই হারিয়ে গিয়েছিল। আমি বোঝার চেষ্টা করেছি একজন মানুষ বখতিয়ারকে, যার জীবনের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, প্রেম ভালোবাসার কথা কেউ বলেনি। ব্যক্তি বখতিয়ারের বর্ণাঢ্য সেই জীবনকে ধরতে গিয়ে, আমাকে বুঝতে হয়েছে তৎকালীন ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। পড়তে হয়েছে প্রথতযশা সব লেখকদের প্রচুর বইপত্র। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ একটা নির্ঘণ্ট পরিশিষ্টে যুক্ত করা হলো। সব শেষে বলি, আমি কোনো ইতিহাস লিখিনি। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লিখেছি। তবে চেষ্টা করেছি, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রাখার। চেষ্টা করেছি, বর্ণিত সকল ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি নির্মোহ ও নিরপেক্ষ থাকার। কতটুকু সার্থক হয়েছি, সে বিচারের ভার রইল বিদগ্ধ পাঠকের উপর।
বাংলাদেশের এক যুবকের কথা ভাবি যে দূরের ছােট্ট দ্বীপ দেশ কিউবার দিকে কৌতূহলে তাকায়। মাত্র বছর বত্রিশের এক তরুণ ক্যাস্ত্রো তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে পরাক্রমশালী আমেরিকার একেবারে নাকের ডগায় ঘটিয়ে ফেলেছিলেন এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তারপর আমেরিকার অবিরাম বিরােধিতা আর চোখ রাঙানির ভেতরও টিকিয়ে রেখেছেন সেই বিপ্লবের মন্ত্রকে। একসময় নদীর পাড় ভাঙার মতাে পৃথিবীর চারদিকে এক এক করে শােনা গেল সমাজতান্ত্রিক চরাচরের ভাঙনের শব্দ; কিন্তু তবু ক্যাস্ট্রো তার নিঃসঙ্গ দ্বীপটিতে জ্বালিয়ে রাখলেন সেই পুরনাে স্বপ্নের বাতিঘর। যুবকের জানতে ইচ্ছা হয় কী করে পারলেন তিনি? ক্যাস্ট্রোর নিজ মুখে সে তখন শােনে নাগরদোলায় চড়া তার আশ্চর্য জীবনের গল্প।