'একা একজন' গ্রন্থে নাওমি ওয়াতানাবে বলেছেন। জীবনের গল্প। যে জীবন কল্পনার নয়। বাস্তবতার। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের যা কিছু অনুষঙ্গ, তার সত্য ও নির্মোহ উচ্চারণ আছে এখানে। ইয়ামাদা, ইয়ুরি, মায়ুমি, হিদে, ইয়ুকা প্রমুখ জীবনের পূর্ণাবয়ব চিত্র নিয়ে গল্পে উপস্থিত হয়নি। তারপরও ইঙ্গিত মধুরতায়, রসঘন নিবিড় মুহূর্তে এবং নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনায় ও পরিমিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে তারা। জীবনের অবিরাম স্রোতে ক্ষনপ্রাণ ও ক্ষণবিলীয়মান যে তরঙ্গ তাই মূর্ত হয়েছে আবশ্যক কথা ও ভাষায়। 'একা একজন' তাই জাপানিদের গল্প শুধু নয়। গল্প পৃথিবীর সকল মধ্যবিত্ত মানুষের।
জাপানের বিখ্যাত অকাল প্রয়াত লেখক নানকিছি নিইমি (১৯১৩-১৯৪৩) ১৭ বছর বয়সে এ গ্রন্থ রচনা করেন। ছবি আঁকেন গেনজিরো মিতা (১৯১৮-২০০০)। এ গ্রন্থে একটি দুষ্ট শিয়ালের করুণ পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি পাঠকের মনে সামান্য হলেও এ গল্প সাড়া জাগাবে। মূল গল্পটি নানকিছির অনন্য সৃষ্টি। আমি অনুবাদের সময় মূল গল্পের স্বাদ ও সৌন্দর্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাপানের বিখ্যাত লেখক টুছিয়া ইউকিয়ো (১৯০৪-১৯৯৯) রচনা করেন এ গ্রন্থ। ছবি আঁকেন মোতোইছিরো তাকেবে (১৯১৪-১৯৮০)। লেখক তিনটি হতভাগ্য হাতির মৃত্যু কাহিনির মাধ্যমে বর্ণনা করেন যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা।
নাওমি ওয়াতানাবে রচনাসমগ্র-১ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে- যাপিত জীবনে আমার বাংলাদেশ, আমি কোথায় দাঁড়াবো, গন শিয়াল, তিনটি হতভাগ্য হাতির মৃত্যুকাহিনি, লেখকের চিঠি, প্রতিবেশীগণ। নাওমি ওয়াতানাবের গ্রন্থগুলোতে বাংলাদেশ ও জাপানের যে জীবনচিত্র, সমাজজিজ্ঞাসা, সংস্কৃতিভাবনা, ঐতিহ্যচেতনা, লোকউপাদান প্রতিফলিত হয়েছে তার মধ্যে লেখকের সুগভীর অর্ন্তদৃষ্টি, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী দক্ষতা সুস্পষ্ট রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। নাওমি এখানে মানুষ ও মানুষের সহযাত্রী হয়েছেন, সারথি হয়েছেন ক্ষুব্ধ জীবনবাদী দ্রোহীজনের।
প্রণয়, আবেগ-ঈর্ষা, দ্বেষ, কলহ, বিরহ, স্বপ্ন-এসব নিয়ে মধ্যবিত্ত জীবন। যে মধ্যবিত্ত উন্নত দেশেও আছে। দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বেও আছে। তাদের সকলের রূপ-রুচি ভঙ্গি-দৃষ্টি এক। যেমন বাংলাদেশে: তেমন জাপানে- কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক। যার কারণে নাওমি ওয়াতানাবে যখন জাপানি মধ্যবিত্তের জীবনের গল্প বলেন, তখন সে গল্প শুধু জাপানের গল্প থাকে না, তা হয়ে উঠে সকল মধ্যবিত্তের- সকল দেশ ও জাতির। নাওমি ওয়াতানাবের 'রূপান্তরের কথকতা' জাপানি মধ্যবিত্তের জীবনকথা হয়েও বাঙালি মধ্যবিত্তের মর্মকথা। ধরিত্রীর সকল মধ্যবিত্তের প্রাণের কথা। -প্রকাশক
উন্নত দেশ জাপান। আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথার্থই উন্নত। জীবন সেখানে আনন্দময় ও উদ্বেগহীন। স্বপ্ন সেখানে নিত্য সহচর। তবে তা কখনােই অসংহত নয়। সংহত ও সংযত কল্পনা, সংযমী ভাবনা, পরিমিত সাহচার্য এবং অলক্ষিত ব্যক্তি সম্পর্কের নিবিড় অন্তরঙ্গতা জাপানি মধ্যবিত্ত সমাজের সাধারন বৈশিষ্ট্য। এই সাধারণ চিত্র অনন্য অসাধারণ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নাওমি ওয়াতানাবের সহােদরা এবং কবি গল্পগ্রন্থে। হিসাশি, গণতা, নানামি, ইয়ানাে, এমিকো, ইয়ুকা, হুমিকো, ইয়ুরি, মিকি, নাওকো, ইয়ামাতাে, কাজু প্রমুখ জাপানি, মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-প্রত্যাশার সীমাবদ্ধতার বৃত্তে বসবাস করে জীবনকে উপভােগ করেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের অংশীজন হয়ে। এদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছে বাঙালি শিশু দীনা, সান্তাক্লুজ ও নিম্নমধ্যবিত্তের বাঙালি জীবনের টানাপােড়েন। সব মিলিয়ে সহােদরা এবং কবি গল্পগ্রন্থের দশটি গল্প জীবনের দশটি দিককে আলােকিত করেছে। ক্ষণকালের দশটি মুহূর্তকে করেছে। চিরকালের। যেন দশদিগন্ত বিস্তৃত হয়ে জীবন কথা রলেছে এখানে।