আমি মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। দেখেছি আমার বাড়ির পার্শ্ব দিয়েই কীভাবে পাক-হায়েনারা ধরে নিয়ে গেছে আমার পিতার বন্ধু বসন্ত কুমার দেবকে। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ছিলেন সরকারি চাকুরে। সবাই পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তিনি পারেননি। যাওয়ার সময় হাউ মাউ করে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, 'আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছো কেন? আমার কী অপরাধ?'ওরা কিছুই শোনেনি।তার কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। বুকে লাগে। আমি দেখেছি, কীভাবে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মজুর, তাঁতী, কামার, কুমার, বেদে, মাঝি-সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিসংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে আমি সেই অহংকার বহন করে চলি। এই গ্রন্থটিকে আমি উপন্যাস নয়, দিবন্যাস বলতে চেয়েছি।যা আমার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখা ও লেখা। একজন মুক্তিযোদ্ধা আরশ আলী। তিনি বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। একজন দিব্যাঙ্গনা সুপ্রিয়া দেবী।তার প্রেম, চাওয়া-পাওয়া শাণিত করেছে আমার ভাবনার পটভূমি। তরুণ প্রজন্মের রাহাত আলী হয়ে উঠেছি এই উত্তর- প্রজন্মের শক্তি ও সাহসের প্রতীক। একটি প্রকৃত জীবনপ্রবাহে আবর্তিত হয়েছে ঘটনা পরিক্রমা, দেশে-বিদেশে। -লেখক
সেদিনের পর ঠিক কী ঘটেছিল লেখক হিসেবে আমি নিজেও জানি না। লেখক হিসেবে নিজের সৃষ্টির এই পরিণতি মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই ঘটনাটি শেষ হলো না। আবার কোনো ঘটনাকে তার মতোই ঘটতে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কী হয়েছিল Triple A এর কিংবা কী ঘটেছিল রোদেলার ভাগ্যে? ঘটনা যদি তার নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে আগামীকাল সকালে ছোট চাচ্চু এয়ারপোর্টে নেমে কী করবে? তাকে সবাই কী জবাব দিবে? কেনই বা সে সাথে আসতে পারল না? নিপা সবাইকে কী জবাব দিবে? তার ভরসাতেই তো সবাই নিশ্চিন্তে ছিল। মোল্লা বাড়ির প্রাণ প্রদীপ এভাবে তো নিভে যেতে পারে না। Triple A এবং রোদেলার মতো সম্ভাবনাময় দুটি প্রাণ- যাদের এখনো অনেক কিছু দেয়ার বাকি এই সমাজকে, এই দেশকে, তথা সমগ্র মানবজাতিকে। তাদের হাত ধরেই রচিত হবে মহাকাল।
মানুষ সৃষ্টির সেরা, তাই তো এই মানুষই সৃষ্টির আশ্চর্যজনক প্রাণি। মানুষের চারিত্রিক গুনাবলী নির্ধারণ করা আজও সম্ভব হয়নি। বাহ্যিক রূপ দেখে বোঝার উপায় নাই তার মনে কি আছে। সহ্য করার প্রবল ক্ষমতা নিয়েও একদিন বাধ ভেঙে ফেলে। সকল মানুষের মনের গহীনে একটি পশু ঘুমিয়ে থাকে। জীবদ্দশায় কারো পশুর ঘুম ভাঙে কারো ভাঙে না। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর কোন উপায় থাকে না। মনের পশুর ভয়ংকরতম রূপের আমি নাম দিয়েছি দানব।
আমি যত সহজে রোশনির এই পর্যন্ত আসা বর্ণনা করলাম কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ ছিল না। বাস্তব যেন হাজার গুণ কঠিন। সুন্দরী হয়ে জন্মানো যেন একটি পাপ মেয়েদের জন্য। আর যদি সে হয় কোনো গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়ে তাহলে তো মহাপাপ। এসএসসি পাস করার পর থেকেই পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, পরিচিতজন, অফিস আদালত যেখানেই রহমান সাহেব যান না কেন সকলের একটাই চিন্তা মেয়ে বিয়ে দেবেন না কেন? সকলের একটাই চিন্তা মাস্টারের মেয়ের বিয়ে দেয় না কেন? যে দেখে তার খোঁজেই দু-চারটা করে সোনার টুকরা ছেলে আছে। যার সাথে রোশনির বিয়ে না হলে যেন রোশনির জীবনটাই বৃথা। এছাড়া বউ ঘরের লক্ষ্মী, তার পড়াশোনা করার কী দরকার? ছেলে ঠা-া ভাত খেতে পারে না। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা- এসব হাজার কাজের জন্য তাদের বউ চাই। এমন হাজারো সমস্যা মোকাবিলা করে রোশনি আজ এখানে। আজকের এই এখানে আসতে যে রোশনিকে কত যুদ্ধ করতে হয়েছে সেটা রোশনির চেয়ে ভালো আর কে জানে?