একদিন মানে সেই দিন ১৫ই আগস্ট ১৯৯৫। গল্পটি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম লেখা গল্প। এতে কোনো সন্দেহ নেই যেহেতু ১৫ই আগস্টের ঘটনা মাঝে একদিন ১৬ আগস্টে জ্বরের ঘোরে বেহাল থেকে ১৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর খসড়া করে গভীর রাতে লেখা গল্প। আমি তখন থাকতাম ২১ নম্বর দীন নাথ সেন রোডে বন্ধু মাসুদের বাসায়। পুরোনা বিশাল বাড়ি আনাচে-কানাচে অনেকেই থাকে। দানেশ মিঞা নামের একজন মাসুদের মায়ের আশ্রিত লোক ঘরে কাজ কাম করতো। মাসুদের মা তেমন পছন্দ করতেন না আমি তার বড় ছেলের রুমে থাকি।বাবা ফুড সাপ্লাই কন্ট্রাক্টর বজলুর রহমান কিন্তু আমাকে অপছন্দ করতেন না। সেটিও মায়ের অপছন্দের হয়তো এর কারণ। রাত নয়টার পর মাসুদ কবি নজরুল ইসলামের নাতনী খিলখিল কাজীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে যেত ফোন মারফতে। কথা বলতেই ক্লান্ত হয়ে পড়তো। তর্ক-বিতর্ক, প্রেম ক্লান্তিকর বিষয় অবশ্য। আমি অপেক্ষায় থাকতাম। ঘুমালেই গল্পের খসড়া নিয়ে বসতাম। মধ্যরাত গড়িয়ে যেতে বজলুর রহমান সাহেব ওজু করতে উঠতেন মাঝ রাতের নামাজ পড়ার জন্যে। বাতাসের জন্যে গরমে দরজা খোলা থাকতো। তিনি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মাথায় হাত রেখে বলতেন প্রতি রাত্রে তুমি কী লেখো বাবা? ওনাকে মিথ্যা বলার প্রশ্নই উঠেনা তাই বলতাম গল্প। তুমি গল্প লেখো? চেষ্টা করি চাচাজান! বুটের লাথি খেয়ে আমার সামনের দেড়টি দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিলো ১৫ই আগস্ট। নারিন্দার এক দাঁতের ডাক্তার পত্রিকা অফিসে পরিচিত কিছুটা সামলে দিয়ে পেইন কিলার দিয়েছিলেন। আজো মনে আছে ১৭ আগস্ট মুখ ঠোঁট ফোলা অবস্থায় খসড়া থেকে মধ্যে রাতে লিখে যাচ্ছি 'একদিন বঙ্গবন্ধু' বজলুর রহমান চাচা ঘরে ঢুকে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন আমার ছেলে দেখো কেমন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ও সারা জীবন ঘুমাবে। দেখবে তুমি আমার ছেলে নও তবু বল্লাম তুমি কিছু করে দেখাতে পারবে। আজ খুব দুঃখ হয় বজলুর রহমান চাচার আত্মার কাছে মাফ চাইতে ইচ্ছা করে। কিছু করে দেখাতে পারলাম না বলে। ১৫ই আগস্ট সকালে সত্যি ঘুম ভেঙ্গেছিলো দানেশ মিঞার মিঞার চিৎক শেখ মুজিবরে মাইরা লাইছে! পাকিস্তান জিন্দাবাদ।' আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম রাস্তায়। পুরানা পল্টন জিপিও সামনে ট্যাংক পার হয়ে রাহাত খানের সেগুন বাগিচা বাসায় যাওয়ার সাহস হয়তো ভূতে জুগিয়েছিলো। রাহাত ভাই অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন, ভাবী পানি ঢালছিলেন মাথায়। ঘণ্টা খানেক পর কিছুটা সুস্থ হয়ে যে দুইজন বিখ্যাত আওয়ামী নেতার কাছে চিরকুট লেখে তিনি পাঠাতেন তাদের বাসায় গিয়ে শুধু গেইটে চেইন ও বিশাল তালা পেলাম। আজ সে নাম বলা ঠিক হবে না যেহেতু এখনো তারা গলার রগ ফুলিয়ে মর্দা মোরগের মত বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ নকল করে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। শেষ পর্যন্ত খুব ইচ্ছা জেগেছিলো ৩২ নম্বর ধানমন্ডির সত্যতা দেখতে। ঘুরে ফিরে নিজকে বাঁচিয়ে চলেও এসেছিলাম কবি সুফিয়া কামালের বাসায়। ভেবেছিলাম এক গøাস পানি খাবো, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে লেকের জল ঘেসে কাছা-কাছি গিয়ে দেখবো ৩২ নম্বর বাড়িতে সত্য কি বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন। কেন যে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না ঠিক জানি না। হিসাবে ভুলের জন্যে লেকের জলের ধার ঘেসে গিয়েও মাথা তোলার পর বুঝলাম একেবারে ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে মাথা তুলেছি। চোখে পড়ে গেলাম, চুল ধরে টেনে তুললো। অকথ্য গালা-গাল আর চড়-লাখি চলো ঠিকই। কেন অস্ত্রের ব্যবহার করলো না কে জানে। শেষ লাখিটা লেগেছিলো মুখে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলাম লেকের জলে। গায়ে পাঞ্জাবী রক্তে-জলে ছিঁড়ে একাকার, খুলে ফেলে খালি গায়ে সাঁতার কেটে উঠলাম শুক্রাবাদের কাছে। তারপর হাঁটতে-হাঁটতে শাহবাগ ঘুরে রমনা পার্কে। শাহবাগের মোড়েও ট্যাঙ্ক ছিলো, সেদিক দিয়ে না গিয়েও পার্কে যেতে পারতাম। সারা গায়ে বিশেষ করে দাঁত হারানো যে ব্যথা তা আর মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে দেয় না। এক উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় দাঁড়া করায়। পার্কে শুয়ে আসলেই উপরের ঘোরে ইউলিশন দেখছিলাম চারদিক থেকে মিছিল আসছে ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষকলীগ আম জনতা শিল্পী সাহিত্যিক সমাজ। আসলে অল্প কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ফুল নিয়ে আসা মিছিল লোকে লোকারণ্য মনে পড়ছিলো। এমন কী গল্পে সম্পূর্ণ উলঙ্গ যৌবনবর্তী পাগলিও সত্যি রড দিয়ে লাইট পোস্টে বাড়ি মারছিলো। আমার ঘোর ভেঙ্গে ছিলো পাগলির বাড়ি দেয়ায়। আমি শুধু এক লাইন যোগ করেছি পাগলির মুখে সংলাপ- 'এদেশে সবাই চিকা'। অর্থাৎ এদেশে কেউ বেটা নেই সবাই হিজড়া কিম্বা নংপুষং। হয়তো এই এক লাইনটি হচ্ছে গল্প, বাকিটা কিছু না।
আর টুটুলের মধ্যে সময়ের পার্থক্য আছে। তবে তারা মানসিক ভাবে বেশ কাছা কাছি। ফার্সি সাহেব জমিদার বংশের মানুষ। তাদের তালুক গেছে তিন পুরুষ আগে ব্রিট্রিশ আমলের শেষ দিনে। তাদের সেই জমিদারী এলাকা ছিলো পদ্মা নদীর কাছা-কাছি। নাম দৌলতিয়া। দৌলতিয়া কে ছেড়ে যেমন সভ্য সমাজ এখন দুরে সরে গেছে। তেমনি পদ্মা নিজকে সরিয়ে ফেলেছে অনেক দুরে। ফার্সির বাবা ডাক্তার ছিলেন। ঢাকায় তার সব ফার্সি সাহেব কিছু তবু তিনি প্রায় দৌলতিয়া গিয়ে নানা ভাবে সাহায্য করতেন। সমাজ দুমড়ে-মুছড়ে যে সব নারীদের ফেলে দিয়েছে তাদেরই ঠাই দৌলতিয়া। তাদের প্রতি নিজের সন্তানের মত মমত্ববোধ ছিলো ফার্সির দাদার এলাকার ধারেই স্কুল করে দিয়ে ছিলেন। তাদের সন্তানদের শিক্ষার আলোর জন্যে স্থানিয় মাস্তানরা চালাতে দেয়নি বেশীদিন। ফার্সির বাবা ডাক্তার হিসেবে সারা জীবন তাদের সেবা করে গেছেন। একসময় এই তালুক ফার্সিদের ছিলো তাই হয়তো এই দায়বদ্ধতা। কি সে দায়বদ্ধতা? না গেলেই চলে। তারা তা করেনি দায় ভালো ভাবে করে গেছে। ফার্সি ও নানা ভাবে আইনী সহায়তা দিতো তাদের। বাবার মত না হলেও মাঝে মধ্যে গিয়ে খোজ খবর নিতো। কতৃপক্ষ ঘেন্না করে অসুস্থ হয়ে মরার সময় মেয়েদের কোন হাসপাতালে ভর্তি করতো না। ফার্সি গিয়ে আইনী যুদ্ধ করে অনেককে হাসপাতালে। ভর্তি করেছিলেন। এরকম বংশের ফার্সি যখন বাধ্য হলেন টুটুলের তরুনী প্রেমিকা পাখিকে নিজেই দৌলতিয়া নিয়ে গিয়ে রেখে আসতে। তখন আরশ কেঁপে ওঠে। যদি আবশ্য উপরে কেপে ওঠার মত কিছু থাকে। যে হেতু পৃথিবীতে মনুষ্যজন প্রতি মুহূর্তে যা ঘটাচ্ছে তাতে উপরে কম্পন নয় ভূমিকম্পনের মতো আকাশ কম্পন হয়ে সব ভেঙ্গে নীচে পরে যেত।
বিন্দু বিন্দু জল- এমন তিনজন মানুষের কথায় তোলপাড় যারা দু'জন দু'জনকে ভালোবাসে। একজন অন্যজনকে ঘৃণা করে। আবার নারী চরিত্র অপর দু'জন পুরুষকে ভালোবেসে নিজের জীবনের খেই হারাতে-হারাতে নিজকে কীভাবে সামলে নেয়Ñ তারই কথা। একমাত্র মনুষ্যজীবনে বিন্দু বিন্দ জল হয়ে চোখ দিয়ে যা বের হয়ে আসে তা আসলে জলের রূপে অন্তর জালার রক্তবিন্দু। প্রত্যেক মানুষ নিজের হিসেব মিলিয়ে সুখি হতে চায়। তবে এই উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র যেন জীবনের হিসাবই বোঝে না। আবেগ রোতে ভাসতে-ভাসতে কাছে আসে, আবার দূরে সরে যায়। তবু যেসব সময় যেসম মূহুর্ত তারা একত্রিতভাবে যাপন করে তা অন্তরে গোপনে সযতেœ তুলে রাখতে চায়। বিচ্ছেদ কী মিলনের চেয়ে মধুর ভাবতে চায়। এসব নিয়ে যেমন শুরু হয় বিন্দ বিন্দু জল' তেমনি এগিয়ে যায় স্রোতের মত সব উল্টে-পাল্টে দিয়ে শেষ হয় পাথর হয়ে আসো মানুষের চোখে বিন্দু বিন্দু জল হয়ে।