স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে সাথেই অসংখ্য বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে পৃথিবীর দূর-দূরান্তে। জীবিকা, প্রাচুর্য আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের মোহিনী হাতছানিতে যেন তীর্থযাত্রার দুঃখ, ক্লান্তি, বিপদ, এমন কি প্রাণ সংহার সবকিছু ভুলে গিয়ে তারা হয়েছে ভিনদেশে পরবাসী। প্রশ্ন হলোঃ এই ভিনদেশ কি প্রার্থিত আনন্দধাম? নাকি দুঃসহ কারাগার? প্রার্থিত নির্বাসনে অপার প্রাচুর্য এবং নিরন্তর কর্মপ্রবাহের মাঝেও ফেলে আসা মাতৃভূমির স্মৃতি অনুভূতির দিগন্তে থাকে ভাস্বর। থাকে চৈতন্যের জ্যোতিষ্কে দীপ্তিমান। দূর-দূরান্ত থেকে কখনও বাংলাদেশকে মনে হয় যেন "নষ্ট পোকার অবিন্যস্ত ঢিবি"। কখনও আবার মনে হয় অতিপৃথিবীতে জেগে ওঠা এক মায়াবী রমণী। ভালবাসা, ক্রোধ, অভিমান, সুখ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা, হারানো স্মৃতি সব মিলে প্রবাসের এই অনুপম দৃশ্যকল্প এক অনবদ্য রূপকে এবং উপমায় উদ্ভাসিত হয়েছে ড. মোস্তফা সারওয়ার-এর কাব্যগ্রন্থ প্রার্থিত নির্বাসনের উন্মাদ পদাবলী-তে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মানচিত্র পরিবর্তনের লগ্ন থেকেই এক দ্রুত রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মানুষ, প্রকৃতি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির রূপান্তর। এর মঙ্গলঘট কি বাঙালি পেয়েছে? অথবা রূপান্তরের বিনষ্ট দানব এসে আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ ও মূল্যবোধকে বিক্ষত করেছে? করেছে রুগ্ন? সেই ব্যাধির বিবিধ ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে ড. মোস্তফা সারওয়ার রচিত বিনষ্ট রূপান্তরের বিকারতত্ত্ব কাব্যগ্রন্থে। সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের বিষয় নিয়ে এ ধরনের কাব্য বাংলা সাহিত্যে বিরল। বিজ্ঞান- বিষয়ক চিত্রকল্পের এমন দক্ষ ব্যবহার শুধু বাংলায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়ও তেমন প্রচলিত নয়। নিরীক্ষাধর্মী নিজস্ব রীতিহীনতার রীতিতে ড. সারওয়ার উত্তর-আধুনিকতার রীতিনীতির সাথে অবৈধ অভিসার করিয়েছেন আধুনিক এমনকি প্রাক-আধুনিক ঐতিহ্যের সময়োত্তীর্ণ ধারাকে। তাঁর অনির্ধারিত গঠন বিন্যাস, অনির্দিষ্ট বস্তু সম্ভার এবং অবাধ্য সংগীতময়তা কবিতার চিরায়ত সংজ্ঞাকে অতিক্রান্ত করে এক অনাবিল আনন্দের প্রবাহ ঘটিয়েছে। কাব্যের দেহে ফুটে উঠেছে এক নবতর সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ যা উদ্বাস্ত করেছে বর্তমানের ঘুনেধরা সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ। এ যেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রতিফলিত জুলিয়া ক্রিসটেভার শিল্পের নতুন সংজ্ঞা।