'রাজাকার ইজ্জত আলীর জীবনের একদিন' বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। গিয়াস উদ্দিন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে চোখটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে গানটা গাইতে শুরু করল, যখন মনে অশান্তি হয় তখন গান গাইলে তার মনটা শান্ত হয়। এখন তার ভেতরে কষ্ট আর অশান্তি, গলা ছেড়ে সুরটা ধরতে পারলেই সে শান্তি পাবে। গিয়াস উদ্দিন কাঁপা গলায় গাইতে শুরু করে- "দয়াময়, ওরে দয়াময় আমারে যদি লইয়া যাইবা তোমার ধারে তাহলে আমারে জনম দিলা কেনে-" প্রচ্ছদঃ আরাফাত করিম ভূমিকাঃ এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক। তবে যে ঘটনার কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলো সত্যি। ঘটনাগুলো ১৯৭১ সালে আমি নিজের চোখে দেখেছি, শুনেছি কিংবা লোকমুখে জেনেছি। ২০১৮ সালের এই সময়টিতে কেন আমি এই উপন্যাসটি লিখেছি তার একটা কারণ আছে। তবে ঠিক কী কারণ জানা নেই, এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরে এক ধরনের গ্লানি অনুভব করছি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বনানী, ২১ আগস্ট ২০১৮
পাকিস্তানী শাসনের শেষ কয়দিনে ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশায় জেনারেল রাও ফরমান আলী জড়িত ছিলেন কি না এবং থাকলে কতখানি জড়িত ছিলেন তার তদন্ত হয়নি। তবে তদানীন্তন পাকিস্তানী সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান হিসেবে তার জড়িত থাকাটা আস্বাভাবিক নয়। তাই বাঙালীর কাঠগড়ায় রাও ফরমান আলী কতখানি অপরাধী সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় বরণ করার জন্যে পাকিস্তানী জনগণের কাঠগড়ায় তখনকার জেনারেলদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই অপরাধ ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি নিষ্কৃতি পেতে অনেক জেনেরেলই আত্মজীবনীতে একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের দোষ ও ভুল-ত্রুটিগুলো ঢাকতে এবং সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছেন। রাও ফরমান আলীও তার ব্যতিক্রম নন। এসব লেখায় তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনাই এসেছে এবং জেনারেলরা নিজেদের সুবিধামতো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সব কারণে পাকিস্তান হেরেছিল, সেসব অনেক ভুল ও দোষ পরস্পরের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর How Pakistan Got Divided বইটি রচনাশৈলী বিন্যাসের দিক থেকে অন্য জেনারেলদের চাইতে অনেক উন্নত। বইটি তিনি কেন লিখেছেন এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী খানের ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেয়েছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশী দেখেছি।” কী দেখেছেন রাও ফরমান আলী খান? বইটিতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তাও কতখানি সত্য? রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসভাজন মনে হবে। এ কৌশল তাঁর জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু ইতিহাস বা ভবিষ্যতের জন্য তা ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানের জনগণ অথবা অন্যান্য দেশের পাঠকের বইটি পড়ার সুযোগ হলেও বাংলাদেশের জনসাধারণের হয়তো সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই বইটিতে রাও ফরমান আলী যুদ্ধের নীতি নির্ধারণে পাকিস্তানী পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হারার বিষয়ে কীভাবে সাফাই গাইছেন পাঠক তা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হতে পারবেন। অনূদিত এই গ্রন্থটিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ বই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠবে, বেরিয়ে আসবে অনেক সত্য। অগোচরে থেকে যাওয়া ইতিহাসের সে সকল সত্য নিয়ে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রাও ফরমান আলী খানের উপস্থাপিত তথ্যের চ্যালেঞ্জ করার জন্য অনেকে এগিয়ে আসবেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উপাত্ত উপাদান ও গবেষণা হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ।
পাকিস্তান মিলিটারি রাত একটায় যে অপারেশন শুরু করে তার নাম 'অপারেশন সার্চলাইট'। ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ছিল ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে। অধিনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলি। তিনি শায়েস্তা করবেন ঢাকা নগরী। মেজর জেনারেল খাদেমের উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা ছাড়া বাকি দেশ শায়েস্তা করার। জোছনা ও জননীর গল্প যাত্রীদের প্রায় সবার হাতেই কিছু-না-কিছু বই। বেশ কয়েকজনের হাতে কোরান শরীফ। অনেকের হাতে প্রচ্ছদে কায়দে আযমের ছবিওয়ালা বই। এইসব বই এখন খুব বিক্রি হচ্ছে। এইসব বই হাতে থাকলে একধরনের ভরসা পাওয়া যায়। মনে হয়, বিপদ হয়তোবা কাটবে। অনিল বাগচীর একদিন একমাত্র মহাপুরুষদের কাছেই ব্যক্তিগত দুঃখের চেয়েও দেশের দুঃখ বড় হয়ে ওঠে। আমরা মহাপুরুষ না- আমাদের কাছে আমাদের কষ্টটাই বড় কষ্ট। সূর্যের দিন
১৯৭১: অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ গ্রন্থটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার প্রথম প্রহরের ওপরে নির্মিত। বহুকাল আগে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার চরমপর্বের ঘটনাবলি বিন্যস্ত করে এই গ্রন্থটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের একাধিক পর্ব রয়েছে। যার মধ্যে চরমপর্ব হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলে সামরিক শক্তি দিয়ে নির্মিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়। এ প্রকারের রাষ্ট্র যে আর টিকতে পারবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। পাক আর্মির অস্তিত্বের জন্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এমন একটি সংকট তৈরি করে, যা সমাধানযোগ্য ছিল না। এটাকে সামলাতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মি সংসদ মুলতবি ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী রুখে দাঁড়ায় অর্থাৎ এ পর্যায় থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চরমপর্ব শুরু হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রতিরোধের প্রথম পর্যায় শেষ হয় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। পরবর্তীতে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জাতীয় যুদ্ধে লিপ্ত হন। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করা। এই গ্রন্থে পহেলা মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত যে অসহযোগ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সেটাকে তথ্য ও দলিলের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। নিরস্ত্র পর্ব অর্থাৎ পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এবং সশস্ত্র পর্বটি ২৫ মার্চ রাতের পর থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত। এরমধ্যে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তারপর পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত করার জাতীয় যুদ্ধ শুরু হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে যে ক'জন গুণী মানুষ একক প্রচেষ্টায় গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে বিমূর্ত করার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অন্যতম লেখক ও গবেষক সালেক খোকন। সাধারণের আড়ালে থেকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা তুলে আনার ক্ষেত্রে তিনি বহু বছর ধরে নিয়োজিত। নিভৃতচারী লেখক নিরলস প্রচেষ্টায় আমাদের 'গৌরব ও বেদনার' মহান মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত মানুষের কথা তুলে আনার ব্রতী হয়েছেন, যাঁরা ছিলেন অন্তরালে। '১৯৭১: যাঁদের ত্যাগে এলো স্বাধীনতা' গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে অজান্তেই। ১৯৭১ সালে বাংলার জমিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের বীরত্বগাঁথা নিজ বয়ানে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিবরণ গ্রন্থটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। গ্রন্থভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস বিনির্মাণে লেখকের যে পবিত্র চেষ্টা অব্যাহত আছে, তাতে এ গ্রন্থ নিঃসন্দেহে গতি আনবে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে। গ্রন্থটিতে লেখক সুনিপুন মুন্সিয়ানায় আমাদের গৌরবের মহান একাত্তরকে বাস্তবতার পটভূমিতেই রেখে সত্য আবহ দিতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের নিজ বর্ণনায় তৎকালীন প্রেক্ষাপটের তথ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দলিল ও আলোকচিত্র উঠে এসেছে, যা নিঃসন্দেহে আগামী ও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
প্রজাপতি পলায়ণ ও রক্ত" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: এই দেশে যারা ১৯৭১ এর ভেতর দিয়ে গিয়েছে তারা সারা জীবনের জন্যে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একাত্তরের স্মৃতি বুঝি শুধু মস্তিষ্কে নয়, এটি বুঝি রক্তের মাঝে ঢুকে গেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভেতর প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের প্রজন্ম পৃথিবীর সবচাইতে নৃশংস প্রজাতি পাকিস্তানী মিলিটারির নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং সব চাইতে ঘৃণিত প্রজাতি রাজাকার আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতা নিজের চোখে দেখেছে। খুব সহজেই এই নৃশংসতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা তাদের পুরো মানবজাতির ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সেটি ঘটেনি। তার কারণ একাত্তরের নয় মাস তারা একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর বীরত্ব এবং দেশের সাধারণ মানুষের একের জন্যে অন্যের ভালোবাসাটুকু দেখেছে। স্বাধীনতার আনন্দ কতো তীব্র হতে পারে সেটি শুধুমাত্র এই প্রজন্ম অনুভব করতে পেরেছে আর কেউ নয়। সেই একাত্তরের প্রজন্ম সেলিম সোলায়মানের লেখা 'প্রজাপতি পলায়ন ও রক্ত" বইটির পাণ্ডুলিপিটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। একাত্তরের বিশাল ব্যাপ্তিকে ধারণ করার মতো ক্যানভাস পৃথিবীতে নেই, তাই তার ওপরে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, সেই হিসেবে এই বইটি একটু অন্যরকম, কারণ লেখক একাত্তরটি দেখেছেন একজন শিশু হিসেবে। ছোট একটা শিশু একাত্তরে কেমন করে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে পারে, যখন প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়ানোর কথা তখন কেমন করে রক্ত দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় সেলিম সোলায়মান আমাদের সেই গল্পটি শুনিয়েছেন।