সবুজ ঘাসের ওপর জমাট বেঁধে আছে রক্ত। কারও রক্ত। আবার মিশে গেছে বেলাইয়ের স্বাচ্ছ জলে। এখানে সেখানে পড়ে আছে শিয়াল-কুকুরে খাওয়া অসংখ্য বীভৎস শরীর। দাউদাউ পুড়ছে বাড়ি-ঘর। বাতাসে কেবলই লাশের গন্ধ। ১৯৭১ সাল ১৪ মে শুক্রবার দুপুর ১টার মিনিট দশেক আগে হঠাৎ করেই পাকিস্তানি বাহিনী। আক্রমণ করে বাড়িয়া এলাকায়। মিশন মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় হিন্দু অধ্যুষিত গাজীপুরের বাড়িয়া। তিন দিকে বেলাই বিলে বেষ্টিত বাড়িয়ায়। নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা। বিল সাঁতরে কিংবা নৌকায় চড়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন শত শত নারী-পুরুষ আর শিশু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নৃশংসতম এই গণহত্যার ঘটনায় কতজন প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি। তবে পাকিস্তানি নরপশুদের হত্যা শিকারের উল্লাসের নিচে শহীদ হন অন্তত দুশ মানুষ। এদের কারোই ঠাই হয় নি স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে। শ'খানেক শহিদের একটি নামের তালিকা ধরে প্রায় ৩ বছর অনুসন্ধানের পর গ্রন্থভুক্ত হলো বাড়িয়া গণহত্যা। বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শহিদ হওয়া সেই সকল নারী-পুরুষ ও শিশুদের নানা অজানা অধ্যায় ও বীভৎস সেই ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। এই গ্রন্থের প্রতিটা পাতাই ভেজা। প্রতিটা শব্দেই যেন লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। প্রতিটা বাক্যই সাক্ষ্য দিচ্ছে-বইটা যেন একাত্তরের বধ্যভূমি।
যে সীমাহীন ত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এসেছিল,তা মানুষের মনে কী স্বপ্ন জন্ম দিয়েছিল, বাস্তবে তাঁরা কী পেলেন, এবং কোন আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কোন পথে গেল সেই বাংলাদেশ- সে সম্পর্কে নিরপেক্ষ ইতিহাস দুর্লভ। এ বইতে লেখক মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপরের বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নানা কারণে একাত্তরের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। একদিকে ছিল একটি জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব ও সমীকরণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এর গন্তব্যে পৌঁছেছে। একাত্তরের এই গতিধারা ও ইতিহাসের খুব অল্পই এখন পর্যন্ত জানা গেছে। একাত্তরের যুদ্ধ শুধু ঢাকা আর ইসলামাবাদের মধ্যে আটকে ছিল না। বাংলাদেশকে নিয়ে বিবদমান পরাশক্তিগুলোর মধ্যে হয়েছিল ছায়াযুদ্ধ। অনেক দৌড়ঝাঁপ হয়েছে কলকাতা, দিল্লি, ওয়াশিংটন, মস্কো আর বেইজিংয়ে। কূটনৈতিক লড়াই হয়েছে জাতিসংঘে। এর একটি বড় অনুষঙ্গ ছিল প্রচারযুদ্ধ। সব ছাপিয়ে উঠে এসেছে ভারতের ভূমিকা। অনেক ঐতিহাসিক দলিলের সূত্র ধরে লেখা এ বই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বাকমুক্তির প্রক্রিয়ায় এক অনন্য সংযোজন, যা পাঠকের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলবে।
১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অপর নাম। আহমদ ছফা বলিয়াছন এ যুদ্ধের নায়ক অন্য কেহ নহেন—খোদ এদেশের জনগণ বা পামর জাতি। (নহিলে ‘আপামর জনগণ’ কথাটার কোনো অর্থই হয় না।) এই প্রস্তাবকেই ‘আহমদ ছফার প্রথম উপপাদ্য’ নাম দিয়াছেন সলিমুল্লাহ খান। রুশ বিপ্লবের লেনিন, চিনের মাও জেদং, কুবার চে গেভারা কিংবা আলজিরিয়ার ফ্রানৎস ফানোঁর মতন বড় কোন তাত্ত্ববিদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে নাই। ফলনের মধ্যে সবেধন সবুজমনি আহমদ ছফা। এই পামর জাতির মন তিনি যতখানি ধরিতে পারিয়াছিলেন আর কেহ ততখানি পারিবেন কিনা সংশয় আছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর বিচার করিয়া যে প্রস্তাব আহমদ ছফা ১৯৭৭ সনে প্রচার করিয়াছিলেন তাহাই বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ গ্রন্থের প্রধান সম্পদ। তদীয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা বইটি হারা্ইয়া যাইতে বসিয়াছিল। আহমদ ছফা মহাফেজখানা প্রথম কাণ্ডে সেই প্রায়লুপ্ত সম্পদই পুনরুদ্ধার করা হইল। আহমদ ছফার উপপাদ্য যদি সত্য হয় তবে মানিতে হইবে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাহে নাই। ভয় ছিল এদেশের স্বাধীনতা সেদেশের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত জাতি-বিজাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মুখে উদাহরণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে। স্বাধীন হইবার তিন যুগ পরও এদেশ আপনকার পাদুকা পরিয়া দাঁড়াইবার পারিল না। কারণে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফল অপরে আত্মসাৎ করিয়াছে। বিপ্লব বেহাত হইয়াছে। ১৯৭১ সনের অপর নাম তাই ‘বেহাত বিপ্লব’। ইতালির মহাত্মা আন্তনিয়ো গ্রামসির বেহাত বিপ্লব প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৭১ সনের বিচার সম্ভবত এই প্রথম।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের জয় পরাজয় বইটির রচনাগুলিতে চোখ ফেললেই বোঝা যায়, এ দেশের জনসাধারণ নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুক্তির জন্যে মরণপণ যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের সেই মুক্তি ঘটেনি। স্বাধীনতার স্বাদ এ দেশের কল্যাণকামী জনগণ পায়নি। কারণ যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলা হয়, সেই দলেরই হাতে এ দেশের মানুষের প্রায় সমস্ত আকাক্সক্ষা দলিত ও ধূলিসাৎ হয়েছে। বইটির পরতে পরতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনব্যবস্থা এ দেশের জনগণের দুশমনেরই কাণ্ডকারখানা। মানুষকে পঙ্গু করে রাখার সব ধরনের আয়োজন কায়েম করে রাখা হয়েছে এখানে। এ ব্যাপারে অন্ধ থাকলে চলবে না- এটাই এ বইয়ের আসল কথা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কিত কিন্তু স্বাপ্নিক, অস্পষ্ট কিন্তু বর্ণাঢ্য এক নাম কর্নেল তাহের। শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্নেল’ বইয়ের কেবল লেখকই নন, বরং তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষকও বটে। রাজনৈতিক চাদরে ঢেকে রাখা একটি চরিত্রকে লেখক পাঠকের দ্বারে টেনে তুলে এনেছেন অপার সাহসিকতা আর সামগ্রিকতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসকে পতিত করে অবিরাম জন্ম দেয়া হয়েছে ধোঁয়াচ্ছন্নতা আর মিথ্যার বেসাতি। লেখক প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মোহ থেকে তুলে ধরেছেন সিনেম্যাটিক অভিযানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগদান করা মুক্তিযোদ্ধা, দুর্ধর্ষ কামালপুর অপারেশনে পা হারানো সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রাচে ভর দেয়া এক স্বাপ্নিক নাগরিক, বিরল আর আপাত ব্যর্থ এক সেপাই অভ্যুথানের নায়ক এবং সর্বোপরি ক্ষুদিরামের পথের অভিযাত্রী কর্নেল তাহের ও সেই ঘোর লাগা সময়ের কুশীলবদের।