সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা আর কিশোরগঞ্জ-এই চার জেলায় ভাটি এলাকার বিস্তার। দুর্গম এই ভাটি এলাকা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন। সেক্টরের আওতাধীন থাকলেও এই অঞ্চলে টেকেরঘাট সাত-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিরাইশাল্লাকে কেন্দ্র করে সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ তাই এই এলাকার প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বের অহংকার। ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতি-নির্ভর আলেখ্য সকল মুক্তিযোদ্ধার অমেয় ত্যাগে সৃষ্ট ইতিবৃত্তের রূপরেখা। ব্যক্তির নয়, সমষ্টিগত অর্জনের গৌরবই এই অহংকার। এই অহংকার। নিজেকে উপলব্ধিরই নামান্তর। প্রায় চার যুগ পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণে অসম্পূর্ণতা থাকতে পারে, কিন্তু অপলাপ কিছু নেই। একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার জবানীতে হানাদারদের সরবরাহ পথ বন্ধ করার মতো অসাধারণ সব সাফল্যের কথা এই বই।
একাত্তরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের ভেতরে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করছেন, ঠিক সে সময়ই প্রবাসী বাঙালিরা বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আরেক রণাঙ্গন খুলেছিলেন। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘ শোষণ-নির্যাতন, বিশেষ করে ২৫ মার্চ থেকে চলা গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সহায়তা সংগ্রহই ছিল তাঁদের সে লড়াইয়ের লক্ষ্য। আর সে লড়াইয়ের অগ্রসেনানীদের একজন ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। সবাই জানেন ১৯৭১এ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মুরুব্বি ছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই যুক্তরাষ্ট্রেরই পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য খুব সহজ কিংবা সাধারণ ব্যাপার ছিল না। এর জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা ও দূরদর্শিতা, অসমসাহস ও দৃঢ় মনোবলের প্রয়োজন ছিল। সেদিন তাঁরা যার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাঙালির জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল ইতিহাসের অনিবার্যতা। তারপরেও বিনা ত্যাগে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয় নি। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পথ বেয়ে ও রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে এই গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। আবার এই চলার পথই নতুন এই রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ গতিপথও নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা পরবর্তীকালে তাতে সাময়িক যতো ব্যাঘাত-বিপর্যয় বা ছন্দপতনই ঘটুক না কেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসে তাঁদের সংগ্রামের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের চলার পথ নির্মাণে তার তাৎপর্যের মতো বিষয়গুলো সবিস্তারে উঠে এসেছে লেখকের মুক্তিযুদ্ধের রচনাসমগ্র বইটিতে। পাঠককে যা শুধু জানাবেই না, একইসঙ্গে ভাবাবেও।
ফ্রান্স ও অন্য স্থানের যেসব স্বেচ্ছাসেবক আমার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল তারা বিভিন্ন। রাজনৈতিক দলের সদস্য। সে সময়ে তারা ভারতের। অবস্থান সম্পর্কে অবশ্যই জানতাে। দুটি ঘটনা তাদের। উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সেক্ষেত্রে বায়াফ্রার স্মৃতি তাদের মনে এক ট্র্যাজিক আবেদন সৃষ্টি করেছিল : এক, দলে। দলে শরণার্থীদের অবস্থান দুই. বাঙালি নিশ্চিহ্নকরণ। – আঁদ্রে মালরাে একটা জাতিকে মিলিটারি দিয়ে পিষে মারা যায়, শ্মশানে পরিণত করা যায়, কিন্তু আজ না হয় কাল আবার যখন সেখানে মানুষের উত্থান হবে তখন সেই মিলিটারিকে। তারা খতম করবে। – জ্যোতি বসু যুক্ত পাকিস্তানের ধারণার কবর হয়েছে। সামরিক । শাসকরা একটি উপনিবেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পারবে শুধু জবরদস্তি সন্ত্রাস ও বর্বর পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা অবলম্বন করে। – সিডনি শনবার্গ সামরিক বল প্রয়ােগে অগণিত মানুষের প্রাণহানি নিপীড়ন ও দুঃখকষ্টের খবরে সােভিয়েত জনগণ। বিচলিত না হয়ে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি এবং নির্যাতন। চালানােয় সােভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ বােধ করছে। – নিকোলাই পদগাের্নি ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে কনসার্টের ব্যবস্থা হলাে । সেইখানেই টানা দু'এক সপ্তাহ কনসার্টের পরিকল্পনা। নিলাম। প্রতিটি শােতে হাজার বিশেকেরও বেশি দর্শক সমাগম হতাে। বাংলাদেশ নামটি রাতারাতি সবার কাছে। পরিচিত হয়ে উঠল। জর্জ হ্যারিসন লিখে ফেললেন বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ । – পণ্ডিত রবিশঙ্কর আল্লাহর নাম আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ভীত নগরী। ঠাণ্ডা মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ২৪ ঘণ্টা গােলাবর্ষণের পর এ নগরীর ৭ হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে। গেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাইমন ড্রিং।
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী সিভিল সোসাইটির নানাবিধ কর্মতৎপরতায় সজীব ছিল। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে এই কর্মতৎপরতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের নানা প্রান্তের কার্টুনিস্টরা তাদের কার্টুনে ফুটিয়ে তুলে ছিলেন একাত্তরের অস্থির ও উত্তাল সময়, পাশাপাশি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ও গণহত্যার বিপক্ষে তাদের অবস্থানও। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে, জনগণের মনে প্রত্যাশা তৈরিতে ও জনমত গঠনে এই কার্টুনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত কার্টুনগুলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে এসব কার্টুন সংগৃহীত হয়েছে।