পুলিশ ভেঙে ফেলল ১৯৫২ সালের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলেন ফরিদপুর কারাগার থেকে অনশন ধর্মঘট করার পর। তাঁর আব্বা তাঁকে নিয়ে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই মুজিব জানতে পারলেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মনোভাব—বাঙালিদেরও উর্দু শিখতে হবে। এবার কী করবেন মুজিব? তাজউদ্দীনরা ভাবছেন, একটা আলাদা দল করতে হবে। গণতন্ত্রী দল গঠনের তৎপরতার সঙ্গে খানিকটা যুক্ত থাকলেন তিনি। মওলানা ভাসানী কারাগারে। সেখান থেকে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া, তাজউদ্দীনের আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আর শেখ মুজিবের মন্ত্রিত্ব লাভ এবং মন্ত্রীর বাড়ি থেকে সোজা জেলযাত্রা। তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে রেনুর অকূলপাথারে পড়ে যাওয়া। রাজনীতির ডামাডোল ওলটপালট করে দেয় ব্যক্তিমানুষেরও জীবন। এই রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কেবল একটি দেশের নেতা বা জনগণ নির্ধারণ করে না, তা নির্ধারণের চেষ্টা চলে ওয়াশিংটন থেকেও। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তো তা-ই বলতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের ইচ্ছাই কি জয়ী হয় না?
১৯৭২ সালে যুদ্ধজয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন ধর্ষিত নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করেছেন। অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ডোরা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান যাঁকে আমরা মিহির নামে জানতাম তাঁদের শরনাপন্ন হই। উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ আমাদের করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি।পরে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে নারকীয় বর্বরতার কাহিনী জানতে পারি। সেই থেকে বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে। নানা সময়ে দিনপঞ্জিতে এঁদের কথা লিখে রেখেছিলাম। ইচ্ছা ছিল, জনসমাজের এঁদের পরিচয় তুলে ধরার। এ ক্ষুদ্র গ্রন্থ সে আগ্রহেরই প্রকাশ। এখানে একটি কথা অবশ্য উল্লেখ। চরিত্রগুলি ও তাঁদের মন-মানসিকতা, নিপীড়ন, নির্যাতন সবই বস্তুনিষ্ঠ। তবুও অনুরোধ অতি কৌতূহলী হয়ে ওদের খুঁজতে চেষ্টা করবেন না। এ স্পর্শকাতরতা আমাদের অবহেলা এবং ঘৃণা ও ধিক্কারের দান। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত করছিলাম। প্রকাশে শঙ্কা ছিল। কিন্তু আমার স্নেহভাজনীয় ছাত্রী কল্যাণীয়া বেবী মওদুদ উৎসাহ, প্রেরণা ও তাঁর অদম্য কর্মক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে এলেন। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলার জন্য ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ ১ম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ভীত কম্পিত হস্তে, সংশয় শঙ্কাকূল চিত্তে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু না, প্রজন্ম একাত্তর এই দেশপ্রেমিক রমণীদের মাতৃসম্মানে সমাদৃত করেছে। তারা জানতে চেয়েছে সেই সাহসী বীরাঙ্গনাদের কথা। তাই সাহসের ভর করে এগুলাম। অনেকে সংবর্ধনা ও সম্মান জানাবার জন্য এঁদের ঠিকানা চেয়েছেন। তার জন্য আরও একযুগ অপেক্ষা করতে হবে। যদি জীবনে সময় ও সুযোগ পাই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের বাসনা রইল ধর্মান্ধতার কালিমা দূরীভূত করতে। আমার প্রকাশকের সঙ্গে অগণিত পাঠকের প্রতি রইলো সকৃতজ্ঞ শুভেচ্ছা। নীলিমা ইব্রাহিম
সিলেট-তামাবিল রাস্তার মাইল চারেকের মধ্যে নন্দীছড়া চাবাগান। সেই বাগানের ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমদ হলেন আরিফের প্রিয় ছােট মামা। তিনি সিলেটে তাদের বাসায় বেড়াতে গেলেই হইচই পড়ে যায়। তার জন্য পাত্রী খােজা হচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যেই এসে পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। তার আগুন আর উত্তাপ নিয়ে। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে পাকিস্তানিরা যখন কাপুরুষের মতাে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঙালিদের ওপর, ইমতি মামা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তার এক বন্ধু রােমানও যােগ দিলেন তার সঙ্গে। মার্চ শেষ হয়ে এপ্রিল এলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকল । আরিফের মা, বড়ভাই আনিস আর বােন রামিসা গেলেন একদিকে, আরিফ গেল রােমান মামার সঙ্গে নন্দীছড়া, তার সঙ্গে গেল তার প্রিয় কুকুর কালু। আরিফের বাবা থেকে গেলেন সিলেটে। পেশায় তিনি ডাক্তার, রােগীর কথা তাকে মনে রাখতে হয়। নন্দীছড়ায় দু’মাসের মতাে থাকল আরিফ, সেই বাগান ও একটু দূরের আলিপুর বাগানের তার বয়সী। চারজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হলাে। দুমাস ধরে অনেক ঘটনা ঘটল। মে মাসের ৩০ তারিখ সকলে মিলে বাগান ছেড়ে গেলেন সীমান্তের দিকে। দুই দল হয়ে চিকন বিল পার হয়ে তারা গেলেন উত্তরে। কিন্তু আরিফ ও তার বন্ধুরা পড়ল শত্রুদের সামনে। তাদের সঙ্গে ছিলেন বাগানের এক কর্মকর্তার স্ত্রী মায়া, আরিফদের মায়া আপা। আরিফ সাহসের সঙ্গে, বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ করল। শত্রুদের মােকাবেলা করল, বাংলাদেশে কিছু যে পাকিস্তান-ভক্ত ছিল তাদেরও। নন্দীছড়ার এই যােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বর্ণনা আছে এই বইটিতে, আছে মুক্তিযুদ্ধ কেন হলাে, তার একটা ব্যাখ্যা। রুদ্ধশ্বাস বর্ণনায় এই ক্ষুদে যােদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের গল্প । নন্দীছড়ার যােদ্ধারা। |
রাত্রি ১২টা। ক্রিং ক্রিং। হাজি মোরশেদ ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো।’ ‘হ্যালো, বলধা গার্ডেন থেকে বলছি।’ ‘আমি শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে বলছি।’ ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। মেশিন কী করব?’ ‘আপনি একটু ধরেন। মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করে আসছি।’ হাজি মোরশেদ দৌড়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে, মেশিন কী করবে জানতে চায়।’ মুজিব বললেন, ‘মেশিন ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’ হাজি সাহেব বুঝলেন, বলধা গার্ডেন একটা কোড। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ পাঠানো হয়ে গেল।শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়া চলেছেন বড় একটা লঞ্চ নিয়ে। নদীর দুধারে বিপুল জনতা টের পেয়ে গেছে এই লঞ্চে আছেন তাদের প্রিয়তম বঙ্গবন্ধু। তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আসছে নেতাকে একনজর দেখবে বলে। এই ভালোবাসার জবাব কেমন করে দেবেন মুজিব? আইয়ুব খান বিদায় নিলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। চীন দাবার ঘুঁটি চালছে, আমেরিকা তৎপর। নির্বাচন এল। মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দীন সক্রিয় দেশের সেরা অর্থনীতিবিদ আর আইনবিদদের নিয়ে, ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো রচনায়। ভাসানীর মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না; তিনি স্লোগান দিচ্ছেন, ভোটের আগে ভাত চাই। নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করল আওয়ামী লীগ। ভুট্টোর সঙ্গে লারকানায় পাখি শিকার করার নামে লাখো বাঙালি হত্যার নীলনকশা প্রস্ত্তত করলেন ইয়াহিয়া। এল একাত্তরের মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আলোচনা ভেস্তে গেল। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, সৈনিকদের বঙ্গবন্ধু আদেশ দিলেন, অস্ত্র গোলাবারুদ হাতে নাও, প্রতিরোধ গড়ো। সবাই অনুরোধ করছে, মুজিব ভাই, ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনি পালান। মুজিব হাসছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি পালাব না। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশকালের ছবি আঁকা রইল এই উপন্যাসে।
গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে কেন পাকিস্তান একটি একক রাষ্ট্র ছিল না, ১৯৭০-এর নির্বাচন কোন সংকট সৃষ্টি করে এবং কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান তার চরম সংকট সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, দখলকৃত বাংলাদেশে তারা নয় মাস কী কী প্রচেষ্টা নেয়, পরিস্থিতি সামলাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ক্রিয়াকর্ম, যা শেষে ব্যর্থ হয় এসবের আলোচনা। এ ছাড়া আছে কীভাবে পাকিস্তানের কার্যক্রম মিডিয়াতে এসেছে, হামুদুর রহমান কমিশনের মূল বক্তব্য, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভ,মিকা নিয়ে তদন্ত করে পাকিস্তান সরকার তার রিপোর্ট এবং সেই সময়ের প্রতিবাদী পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকার। শেষে রয়েছে নির্বাচিত প্রামাণিক দলিল ও নয় মাসের ঘটনা।
নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং 'কে' ফোর্স ছিল বেশ তৎপর। সেক্টর এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে চলত বিরামবিহীন অভিযান। এ গ্রন্থে এসব অভিযানের ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন সেক্টর এবং ফোর্স কমান্ডার মেজর (পরে লে. কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। গ্রন্থটি ২ নম্বর সেক্টর এবং ফোর্সের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস। কমান্ডারের বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে যুদ্ধসংশ্লিষ্ট দলিল, ছবি, মানচিত্র এবং আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য। সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডারের কেউ কেউ তাঁদের এলাকার আংশিক বা খণ্ডিত ইতিহাস লিখেছিলেন, কিন্তু মেজর খালেদ রেখে গেছেন ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের খতিয়ান।