মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতা নিয়ে গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্যগ্রন্থের অভাব বহুকালের, যদিও ভিনদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ১৯৭১-এর প্রতিবেদনগুচ্ছ আগ্রহী পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে ইতোমধ্যে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সংবাদদাতা, লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হারুন হাবীব সেই অভাব পূরণের চেষ্টা নিয়েছেন। এই গ্রন্থে দেশীয় ও মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে-যা জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক অধ্যায়। এ ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জোগাতে ভারতীয় পত্রপত্রিকার যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, তা নিয়েও বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে- যা আগে হয় নি। আমাদের বিশ্বাস বইটি আগ্রহী পাঠকদের দৃষ্টি কাড়বে এবং মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতার ওপর প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রথম অধ্যায়ে দেশ ও জনগােষ্ঠির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যে দেশের ইতিহাস আমরা পড়ছি অর্থাৎ বাংলাদেশের এবং বাঙালির, তার একটি পরিচিতি দরকার। এটি না জানলে নিজেকে জানা হয় না। এ অধ্যায়ে আমরা এ দেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আলােচনা করেছি। যে বিষয়টিতে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে তা হলাে এই ভূপ্রকৃতি প্রাচীন কাল থেকে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং কীভাবে তা বাঙালি মানস গঠনে প্রভাব ফেলেছে। আলােচিত হয়েছে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষা।
পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চে তখন তিনটি প্রধান পক্ষ—আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি এবং সেনাবাহিনী। আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা প্রবেশ করেছিলাম একটা রক্তাক্ত অধ্যায়ে। এই বইয়ে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ-পর্বের একটা ছবি এঁকেছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম স্বাভাবিকভাবে হয়নি। একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র, তা-ও আবার আপসে নয়, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন উদাহরণ বিরল। বাংলাদেশের ঠিকুজি খুঁজতে গেলে আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এই বইয়ে আছে দলটির ওই সময়ের পথচলার বিবরণ, যখন দেশ একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধ ছিল বাঙালির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের অনিবার্য গন্তব্য। আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা একটা রক্তাক্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছিলাম। আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ওই পর্বের একটা ছবি আঁকা হয়েছে এই বইয়ে।
ডানপিটে এক কিশোর ফজল। ১৯৭১ এর উত্তাল সময়ে সে স্কুল পড়ুয়া। পড়ালেখায় খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও মারামারিতে সে সবচেয়ে এগিয়ে। কারণ ওর ডাকাবুকো সুঠাম গঠন। শিক্ষক বাবার চিন্তার অন্ত নেই তাকে নিয়ে- বাবার মুখ কখনোই উজ্জ্বল করতে পারবে না সে। কিন্তু এই আপাত বখে যাওয়া কিশোর একাত্তরের উত্তাল সময়ে অস্ত্র হাতে নেমে পরে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার শপথ নিয়ে। কিশোর মন তার, স্বাধীন দেশে ঘরে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করে যায় সে। চোখে তাঁর ঘরে ফেরার স্বপ্ন, সম্মুখে শত্রুসেনা। সে কি ঘরে ফিরতে পারবে? ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এর রাশেদের পর ‘ফজল’ হতে যাচ্ছে সব বয়সী পাঠকের প্রিয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা।
আজাদ ছিল তার মায়ের একমাত্র সন্তান। আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় বালক আজাদকে নিয়ে তার মা স্বামীর গৃহ-অর্থ-বিত্ত ত্যাগ করে আলাদা হয়ে যান। মা বড় কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করান। আজাদ এমএ পাস করে। এই সময় দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আজাদের বন্ধুরা যোগ দেয় ঢাকার আরবান গেরিলা দলে। আজাদ মাকে বলে, আমিও যুদ্ধে যাব। মা তাকে অনুমতি দেন। ছেলে যুদ্ধে যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট একরাতে ঢাকার অনেক ক'টা মুক্তিযোদ্ধা-নিবাসে হামলা চালায় পাকিস্তানী সৈন্যরা, আরো অনেকের সঙ্গে ধরা পড়ে রুমী, বদি, আলতাফ মাহমুদ, জুয়েল এবং আজাদ। আজাদের ওপর পাকিস্তানীরা প্রচণ্ড অত্যাচার চালিয়েও কথা বের করতে পারে না। তখন তার মাকে বলা হয়, ছেলে যদি সবার নাম-ধাম ইত্যাদি বলে দেয়, তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন, শক্ত হয়ে থেকো, কারো নাম বলে দিও না। আজাদ বলে, মা দুদিন ভাত খাই না, ভাত নিয়ে এসো। মা পরের দিন ভাত নিয়ে হাজির হন বন্দিশিবিরে, কিন্তু ছেলের দেখা আর মেলে না। আর কোনোদিনও ছেলে তার ফিরে আসে নাই আর এই মা আর কোনোদিনও জীবনে ভাত খান নাই। যুদ্ধের ১৪ বছর পরে মা মারা যান, নিঃস্ব, রিক্তবেশে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে কবরে শায়িত করলে আকাশ থেকে ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে বৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই কাহিনীর সন্ধান পেয়ে আনিসুল হক বহুজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে, বহু দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে রচনা করেছেন অসামান্য এক উপন্যাস, জানাচ্ছেন এক অসমসাহসিকা মায়ের অবিশ্বাস্য কাহিনী। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন স্বাধীনতা থাকবে, এই অমর মাকে ততদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে আমাদের।
পর্বত-কন্যা কাকন বিবি সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের একজন, জীবনের চলার পথে তাঁকে বহু বাধা বিঘ্ন মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। পার্বত্য জাতিসত্তার সদস্য হিসেবে রূপ-লাবণ্যে তিনি অনেকের দৃষ্টি কেড়েছেন, আবার দরিদ্র অবহেলিত নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কালো থাবা তাঁর দিকে প্রসারিত হয়েছে বারবার। বিচিত্র তাঁর জীবন-কথা, তার চেয়েও কঠিন তাঁর জীবন-যুদ্ধ। নির্যাতিত হয়েছেন একাত্তরে, যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, শত্রু শিবিরে প্রবেশ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে, আবার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর হারিয়ে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেক বিলম্বে হলেও এক সময় উদ্ভাসিত হয় তাঁর বীরত্ব-গাথা, সংবর্ধিত হন তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান রাষ্ট্রের তরফ থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পান ঊষ্ণ ভালোবাসা। অখ্যাত অজ্ঞাত এই বীর নারীর জীবন-ভাষ্য রচনা করেছেন একনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। কঠিন সেই দায়িত্ব দক্ষতা ও মমতার সাথে পালন করেছেন তিনি। কাকন বিবির জীবনের পূর্বাপর এই বয়ান তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের আলোড়িত করবে নিশ্চয়, সেই সঙ্গে আলোকিতও।