বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী হয়ে বাস করেছেন বাংলাদেশের মানুষেরা। এই পটভূমিতে রচিত হয়েছে শরণার্থীর সুবর্ণরেখা উপন্যাস। এটি নিঃসন্দেহে সময়ের ছায়াশিল্প। শরণার্থী জীবনের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে শরণার্থীদের বসবাস এই সময়ের পাঠকবৃন্দ নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার সময়কে খুঁজে পাবেন। এই সময়কে বোঝার ভেতর আত্ম-আবিষ্কারের চিত্র পাবেন। আর নতুন প্রজন্ম, যাঁদের স্বাধীনতার পরে জন্ম হয়েছে, তাঁরা শরণার্থীদের জীবনযাপন বুঝতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চিত্র পাবেন। শরণার্থীদের সুবর্ণরেখা শিল্পের মানসভূমি।
স্বাধীনতা যুদ্ধ একাত্তর আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষার ধন স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে অনেক মৃত্যু, নারী নির্যাতন ও অনেক ধ্বংসের বিনিময়ে। সে যুদ্ধের রূপরেখা ও সামাজিক শ্রেণীচরিত্র নানামাত্রায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আহমদ রফিক 'বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ বইটিতে। স্বাধীনতাযুদ্ধের রাজনৈতিক চরিত্র যথেষ্ট জটিল বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যা আবার নানা প্রশ্নের বিদ্ধ। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও আর্থসামাজিক তাৎপর্য ও ইতিহাসের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে রয়েছে রাজনীতির পাশাখেলা ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের চাতুর্য, ক্ষমতা দখলের রোভ-লালসা। জীবন সেখানে তুচ্ছ তা যত মূল্যবানই হোক। স্বাধীনতাযুদ্ধের নেপথ্যে ছিল বাঙালি জাতীয়তার চেতনা। সে চেতনা কতটা সমাজে বিরাজমান বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্তির দিকনির্দেশক তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক বিতর্ক। সেসবও এই বইয়ে নানা প্রসঙ্গে আলোচিত। এমনকি আলোচিত স্বাধীনতা যুদ্ধ বনাম মুক্তিযুদ্ধের তাত্ত্বিক বিচার। আরও একটি বিতর্কিত বিষয় ইতিহাসে স্বাধীন বাংলার অবস্থান যা সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে 'বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ' ঘটনার সরলরৈখিক বয়ান নয়, ইতিহাসের নানা কোণে আলো ফেলার চেষ্টা রয়েছে এতে এবং তা কখনো প্রথাসিদ্ধ ইতিহাসের বাইরে অথচ ইতিহাসেরই নেপথ্য আলেখ্য রচনার লক্ষ্যে।
প্রথম ব্যাচে যারা গিয়েছিল, তারা আগস্ট মাসের প্রথম দিনে হঠাৎ করে যুব-শিবিরটায় এসে সকলকে চমকে দিল। তাদেরকে চমকে দিয়ে কিছুক্ষণ পর অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেখান থেকে আরও সরজন চলে গেলে কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। যারা যেতে পারল না তারা আফসোসে ভরে উঠল। কারও চোখে শ্রাবনের ঢল নেমে এল। অনেক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের থেকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় তালিম নিতে ব্যাকুল হয়ে গেল। অনেকে প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের সাথে দেশের ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করল। কারণ যুব-শিবিরের অবস্থা তখন পাকি-মিলিটারীর ভয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারা একই অবস্থা দেখে আসছে দীর্ঘদিন ধরে এবং তার কোনো পরিবর্তের চিহ্ন দেখতে পায়নি। ভয়ানক বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে সর্বদা কালো মেঘের ঘনঘটা। নদীর পানির রঙ যেমন বদলেছে, তেমনি তার স্রোতের তুখোড়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। রহমান শরণার্থী-ক্যাম্পের অবস্থা জানতে গিয়ে দেখতে পায়, আগের সেই নদীটা দুকূল ছাপিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে চলে এসেছে। যেন তারও থাকার মতো কোনো আশ্রয় নেই। কালিগঙ্গা ঘোলাস্রোত নিয়ে তুখোরভাবে ছুটে চলে, সাপের মতো পাক খায়। কুণ্ডলি পাকায়। তাতে ভেসে চলে দূরবর্তী শহরের যতোসব আবর্জনা, জঞ্জাল আর মরামারীতে মৃত শরণার্থীর ফোলাপচা গলিত প্রায় লাশ। স্বাধীনতার জন্য ইতোপূর্বে এতো আত্মহুতি কী দিতে হয়েছে কোনো জাতির, ব্যাপারটা আকস্মিকভাবেই যেন ভাবিয়ে তোলে রহমানকে। দেশের ভেতরের প্রত্যেকটি বসতীতে মিলিটারি হামলা চালাচ্ছে তাদের দোসর, আলবদর-রাজাকার বাহিনীর সাহায্যে। তারা খোঁজখবর নিয়ে বিশেষ-বিশেষ গ্রাম রাতের আঁধারে ঘিরে ফেলছে। তারপর দিনের আলোয় সেখানকার প্রত্যেকটি যুবক ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করছে। নারীদের লাঞ্ছিত করছে। সর্বশেষ তাদের সম্পদ লুট করে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে তাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখছে। সেখানকার ডোবানালায় অগনিত মানুষের লাশ ভাসছে। প্রত্যেক মুহুতেই সেখানে এক বা একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে...।
আমাদের জন্মগল্পের উপাখ্যান। কোন দূর গ্রামের এক নারী একদা তাড়া খেয়ে ফিরছিল, ফেলে যাচ্ছিল তার ভিটে-মাটিকে, কোলে ছ'মাসের সন্তান। নদী-খাল পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। তার এখন গল্প শুধু সময়ের সাথে, তাঁর এখন গল্প শুধু নিজের সাথে। পাশ দিয়ে ওর মতই আরো নারী-শিশুরা হাঁটছে, হাঁটছে, কারো হাতে ছোট পোটলা, কোন কিশোরীর হাতে আহত হয়ে যাওয়া বিড়াল ছানা অথবা শালিক পাখির বাচ্চা। লেখিকা ফিরে গিয়েছেন একাত্তরের সেই ভয়ংকর সময়ে। গল্পের গাঁথুনিতে গড়ে তুলেছেন এক একটি সত্য ঘটনাকে, দিয়েছেন বুনন। আমরা চলে গিয়েছি কখনো ত্রিপুরায়, কখনো পুরান ঢাকার নারিন্দা বাজারে, নইলে বুড়িগঙ্গার ওপারে কামরঙ্গির চর হয়ে আবারো বিলেতের রাস্তায় কোন হিউম্যানিস্টের মিছিলে। এ শব্দমালা কোন গল্প নয়, নয় কোন রোমান্সের পঙক্তিমালা। এ বাক্যের সারিরা ইতিহাস, আমাদের জন্মের ইতিহাস, আমাদের মায়ের গর্ভাশয়ের ইতিহাস।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগ, ১৯৫২-এ ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এ মহা মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা যেমন আছে প্রচুর, গল্পও আছে প্রচুর। মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই দেশের সাহিত্যিকেরা সাহিত্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্যে এসেছে নতুন একটি মোড়। নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় আমাদের সাহিত্যিকদের। সেই অভিজ্ঞতালব্ধ মুক্তিযুদ্ধ পটভূমিতে লেখা এমন কয়েকটি গল্প নিয়ে এই সংকলন। সংকলনের গল্পগুলো আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, সেই সাথে আমাদের লাল সবুজ পতাকা চিরকালের জন্য সমন্নত রাখবে এই আশা রাখি। আনিসুজ্জামান কাজল
মানবিক অনুভূতিগুলোকে অবিভাজ্য রেখে দেশে দেশে সীমানা বিভাজিত হয়। এই বিভাজনের খেলার ক্রীড়ক ও ক্রীড়নক থাকে মানুষ নিজে। যুগে যুগে মানুষের ইশারাতেই মানুষের রক্ত ঝরে, ভূখ-ের সীমানা নির্ধারিত হয়, দেশের প্রান্তসীমায় কাঁটাতার বসে, এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে ঠাঁই নেয় মানুষ। দেশ ছাড়া আর দেশ হারা যেভাবেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন এই মানুষগুলোর হাহাকার যেন জলের রেখা ছাড়া আঁকা যায় না।