গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে কেন পাকিস্তান একটি একক রাষ্ট্র ছিল না, ১৯৭০-এর নির্বাচন কোন সংকট সৃষ্টি করে এবং কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান তার চরম সংকট সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, দখলকৃত বাংলাদেশে তারা নয় মাস কী কী প্রচেষ্টা নেয়, পরিস্থিতি সামলাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ক্রিয়াকর্ম, যা শেষে ব্যর্থ হয় এসবের আলোচনা। এ ছাড়া আছে কীভাবে পাকিস্তানের কার্যক্রম মিডিয়াতে এসেছে, হামুদুর রহমান কমিশনের মূল বক্তব্য, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভ,মিকা নিয়ে তদন্ত করে পাকিস্তান সরকার তার রিপোর্ট এবং সেই সময়ের প্রতিবাদী পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকার। শেষে রয়েছে নির্বাচিত প্রামাণিক দলিল ও নয় মাসের ঘটনা।
পাকিস্তানী শাসনের শেষ কয়দিনে ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশায় জেনারেল রাও ফরমান আলী জড়িত ছিলেন কি না এবং থাকলে কতখানি জড়িত ছিলেন তার তদন্ত হয়নি। তবে তদানীন্তন পাকিস্তানী সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান হিসেবে তার জড়িত থাকাটা আস্বাভাবিক নয়। তাই বাঙালীর কাঠগড়ায় রাও ফরমান আলী কতখানি অপরাধী সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় বরণ করার জন্যে পাকিস্তানী জনগণের কাঠগড়ায় তখনকার জেনারেলদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই অপরাধ ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি নিষ্কৃতি পেতে অনেক জেনেরেলই আত্মজীবনীতে একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের দোষ ও ভুল-ত্রুটিগুলো ঢাকতে এবং সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছেন। রাও ফরমান আলীও তার ব্যতিক্রম নন। এসব লেখায় তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনাই এসেছে এবং জেনারেলরা নিজেদের সুবিধামতো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সব কারণে পাকিস্তান হেরেছিল, সেসব অনেক ভুল ও দোষ পরস্পরের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর How Pakistan Got Divided বইটি রচনাশৈলী বিন্যাসের দিক থেকে অন্য জেনারেলদের চাইতে অনেক উন্নত। বইটি তিনি কেন লিখেছেন এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী খানের ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেয়েছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশী দেখেছি।” কী দেখেছেন রাও ফরমান আলী খান? বইটিতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তাও কতখানি সত্য? রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসভাজন মনে হবে। এ কৌশল তাঁর জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু ইতিহাস বা ভবিষ্যতের জন্য তা ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানের জনগণ অথবা অন্যান্য দেশের পাঠকের বইটি পড়ার সুযোগ হলেও বাংলাদেশের জনসাধারণের হয়তো সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই বইটিতে রাও ফরমান আলী যুদ্ধের নীতি নির্ধারণে পাকিস্তানী পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হারার বিষয়ে কীভাবে সাফাই গাইছেন পাঠক তা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হতে পারবেন। অনূদিত এই গ্রন্থটিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ বই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠবে, বেরিয়ে আসবে অনেক সত্য। অগোচরে থেকে যাওয়া ইতিহাসের সে সকল সত্য নিয়ে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রাও ফরমান আলী খানের উপস্থাপিত তথ্যের চ্যালেঞ্জ করার জন্য অনেকে এগিয়ে আসবেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উপাত্ত উপাদান ও গবেষণা হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ।
রাত্রি ১২টা। ক্রিং ক্রিং। হাজি মোরশেদ ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো।’ ‘হ্যালো, বলধা গার্ডেন থেকে বলছি।’ ‘আমি শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে বলছি।’ ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। মেশিন কী করব?’ ‘আপনি একটু ধরেন। মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করে আসছি।’ হাজি মোরশেদ দৌড়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে, মেশিন কী করবে জানতে চায়।’ মুজিব বললেন, ‘মেশিন ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’ হাজি সাহেব বুঝলেন, বলধা গার্ডেন একটা কোড। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ পাঠানো হয়ে গেল।শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়া চলেছেন বড় একটা লঞ্চ নিয়ে। নদীর দুধারে বিপুল জনতা টের পেয়ে গেছে এই লঞ্চে আছেন তাদের প্রিয়তম বঙ্গবন্ধু। তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আসছে নেতাকে একনজর দেখবে বলে। এই ভালোবাসার জবাব কেমন করে দেবেন মুজিব? আইয়ুব খান বিদায় নিলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। চীন দাবার ঘুঁটি চালছে, আমেরিকা তৎপর। নির্বাচন এল। মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দীন সক্রিয় দেশের সেরা অর্থনীতিবিদ আর আইনবিদদের নিয়ে, ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো রচনায়। ভাসানীর মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না; তিনি স্লোগান দিচ্ছেন, ভোটের আগে ভাত চাই। নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করল আওয়ামী লীগ। ভুট্টোর সঙ্গে লারকানায় পাখি শিকার করার নামে লাখো বাঙালি হত্যার নীলনকশা প্রস্ত্তত করলেন ইয়াহিয়া। এল একাত্তরের মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আলোচনা ভেস্তে গেল। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, সৈনিকদের বঙ্গবন্ধু আদেশ দিলেন, অস্ত্র গোলাবারুদ হাতে নাও, প্রতিরোধ গড়ো। সবাই অনুরোধ করছে, মুজিব ভাই, ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনি পালান। মুজিব হাসছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি পালাব না। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশকালের ছবি আঁকা রইল এই উপন্যাসে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি সম্পূর্ণরূপে অনালোচিত অধ্যায় ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত শিলিগুড়ি সম্মেলন। এই সম্মেলন অনেক বিভ্রান্তি দূর করে যুদ্ধের সময় অনুসরিীত নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে। এই সম্মেলন নিয়ে আসে সংহতি, ত্বরান্বিত করে পরিকল্পিত যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যায় দ্রুত বিজয়ের দিকে। কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ ও দাপ্তরিক কার্যপ্রণালি কোথাও সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রথমা প্রকাশিত 1971: The Siliguri Conference বইটিতে প্রথমবারের মতো সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈঠকের কার্যপ্রণালি এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশিত হয়। সঙ্গে ছিল বিশদ ভূমিকা। এই বই সেই ঐতিহাসিক দলিলের নির্ভরযোগ্য সুসম্পাদিত বাংলা অনুবাদ।
ড. কামাল হোসেন আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক কালপর্বের প্রত্যক্ষদর্শী। কখনো নেপথ্যে আবার কখনো প্রকাশ্যে তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষের অন্যতম আইনজীবী। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সাংবিধানিক পরামর্শদাতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের তরফে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনায়ও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী। তাঁরই নেতৃত্বে প্রণীত হয় বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি স্থাপনে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাসের সেসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—জানা-অজানা নানা তথ্য ও ঘটনা গ্রন্থভুক্ত কামাল হোসেনের দীর্ঘ দুটি সাক্ষাৎকারে সবিস্তার উঠে এসেছে। এ ছাড়া গ্রন্থের অন্য লেখকেরাও তাঁদের রচনায় নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে ও বস্ত্তনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের জন্ম ও বিকাশে ড. কামাল হোসেনের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস জানতে ও বুঝতে পাঠককে সহায়তা করবে এ বই।
বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার, নারী মুক্তিযোদ্ধার বিপুল সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর ইতিহাস অনেকটাই উপেক্ষিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে দেশবাসী তেমন করে জানেনই না। এই অনালোকিত অন্ধকার জগতে আলো ফেলে ইতিহাসের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাসমনস্ক করতে এবং আমাদের ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হবে পরিশ্রমী গবেষণায় লেখা বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা' গ্রন্থটি।