একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী সিভিল সোসাইটির নানাবিধ কর্মতৎপরতায় সজীব ছিল। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে এই কর্মতৎপরতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের নানা প্রান্তের কার্টুনিস্টরা তাদের কার্টুনে ফুটিয়ে তুলে ছিলেন একাত্তরের অস্থির ও উত্তাল সময়, পাশাপাশি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ও গণহত্যার বিপক্ষে তাদের অবস্থানও। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে, জনগণের মনে প্রত্যাশা তৈরিতে ও জনমত গঠনে এই কার্টুনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত কার্টুনগুলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে এসব কার্টুন সংগৃহীত হয়েছে।
দেশের ভেতরে ও বিশ্বজুড়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটেছিল অসংখ্য ঘটনা। পক্ষে-বিপক্ষে ভূমিকা রেখেছিল অগণিত মানুষ। প্রতিটি তারিখ ধরে ধরে সেসব ঘটনা এ বইয়ে সংকলনবদ্ধ করা হয়েছে। বইটি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনা-অভিধান। গবেষক ও কৌতূহলী পাঠকের হাতের নাগালে রাখার বই।
১৯৭১: অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ গ্রন্থটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার প্রথম প্রহরের ওপরে নির্মিত। বহুকাল আগে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার চরমপর্বের ঘটনাবলি বিন্যস্ত করে এই গ্রন্থটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের একাধিক পর্ব রয়েছে। যার মধ্যে চরমপর্ব হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলে সামরিক শক্তি দিয়ে নির্মিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়। এ প্রকারের রাষ্ট্র যে আর টিকতে পারবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। পাক আর্মির অস্তিত্বের জন্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এমন একটি সংকট তৈরি করে, যা সমাধানযোগ্য ছিল না। এটাকে সামলাতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মি সংসদ মুলতবি ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী রুখে দাঁড়ায় অর্থাৎ এ পর্যায় থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চরমপর্ব শুরু হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রতিরোধের প্রথম পর্যায় শেষ হয় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। পরবর্তীতে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জাতীয় যুদ্ধে লিপ্ত হন। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করা। এই গ্রন্থে পহেলা মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত যে অসহযোগ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সেটাকে তথ্য ও দলিলের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। নিরস্ত্র পর্ব অর্থাৎ পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এবং সশস্ত্র পর্বটি ২৫ মার্চ রাতের পর থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত। এরমধ্যে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তারপর পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত করার জাতীয় যুদ্ধ শুরু হয়।
অনেকদিন আগের কথা, তখন সেটা ছিল উনিশ শ একাত্তর সাল। এই দেশে তখন পাকিস্তানী মিলিটারি কিলবিল কিলবিল করতো, তাদের পিছনে পিছনে থাকতো রাজাকার বাহিনী। এই দুই দল মিলে দেশের মানুষ মেরে, অত্যাচার করে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সবকিছু শেষ করে দিচ্ছিল। তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে এই দেশের চাষী, মজুর, জেলে আর ছাত্ররা মিলে তৈরি করেছিল মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানী মিলিটারির ছিল ভয়ংকর ভয়ংকর সব অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু তাদের বুকের ভিতর ছিল সাহস আর ছিল দেশের জন্যে ভালবাসা।।
সরদার ফজলুল করিমের পৃথিবী ছিল নিরন্তর অনুসন্ধানের। বিপুল বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা আর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর জীবন। ফলে দিনপঞ্জিতে লেখা নিত্যদিনের খুব সাধারণ ঘটনার মধ্যেও জীবন-জগৎ আর ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গভীর বোধের পরিচয় পাওয়া যায়। সরদার ফজলুল করিমের দার্শনিক মন সারাক্ষণ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানা জটিল জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে ফিরেছে। আপন জীবন এবং সমকালীন ইতিহাসকে পরিপ্রেক্ষিতে রেখে তিনি দেশ ও সমাজকে উপলব্ধির প্রয়াস করেছেন। সমস্যা আর সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছেন। আবার জীবন বলতেও জীবনের বহুমাত্রিক দিক উঠে এসেছে তাঁর এসব ভাবনালিপিতে। আমার পৃথিবী বইয়ে তাঁর লেখাগুলো ডায়েরি-আশ্রিত। সেগুলোকে দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, দেশ, জীবন, সাহিত্য—এভাবে পর্ববিন্যস্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। সাহিত্য অংশে স্থান পেয়েছে বই ও লেখক নিয়ে তাঁর পাঠানুভূতি। সরদার ফজলুল করিমের চিন্তাজগৎকে বুঝতে বিশেষ সহায়ক হবে বইটি।
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা আর কিশোরগঞ্জ-এই চার জেলায় ভাটি এলাকার বিস্তার। দুর্গম এই ভাটি এলাকা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন। সেক্টরের আওতাধীন থাকলেও এই অঞ্চলে টেকেরঘাট সাত-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিরাইশাল্লাকে কেন্দ্র করে সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ তাই এই এলাকার প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বের অহংকার। ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতি-নির্ভর আলেখ্য সকল মুক্তিযোদ্ধার অমেয় ত্যাগে সৃষ্ট ইতিবৃত্তের রূপরেখা। ব্যক্তির নয়, সমষ্টিগত অর্জনের গৌরবই এই অহংকার। এই অহংকার। নিজেকে উপলব্ধিরই নামান্তর। প্রায় চার যুগ পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণে অসম্পূর্ণতা থাকতে পারে, কিন্তু অপলাপ কিছু নেই। একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার জবানীতে হানাদারদের সরবরাহ পথ বন্ধ করার মতো অসাধারণ সব সাফল্যের কথা এই বই।