বঙ্গবন্ধুর জীবনের ক্যানভাস বহু রঙে রঙিন। জীবন ও জগতের সব ছবি সেখানে প্রতিফলিত। এই সুপরিসর মোজাইকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন আছে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হয়েছে, পাকিস্তানের শোষণ-শাসন যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে-ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার ঘোষণা আছে এবং সবশেষে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, উদারতা ও সংকীর্ণতা, লোভ ও স্বার্থত্যাগ, বন্ধুত্ব ও বৈরিতা, আনুগত্য ও বিশ্বাসঘাতকতা, নৈরাজ্য ও আশাবাদ, এক কথায় মানুষের জীবনের সব দিক তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। একজীবনে এমন বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জনের দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। এই অতুলনীয় অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনকে দিয়েছে এপিকের বিশালতা। আধুনিক কালের এই এপিকে সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সগর্বে উজ্জীন জয়ের পতাকা। বিজয়ের স্থপতি হিসেবে তিনি জীবদ্দশাতেই হয়ে গিয়েছেন কিংবদন্তির নায়ক। মৃত্যুর পর তাঁর জীবন ইতিহাসের ঊর্ধ্বে উঠে রূপান্তরিত হয়েছে রূপকথার কাহিনিতে। সেই অবিস্মরণীয় কাহিনি নিয়ে লেখার শেষ নেই, কখনো হবে না। খ্যাতিমান কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাইয়ের বারোটি গল্পের এই অনবদ্য সংকলনে প্রতিফলিত হয়েছে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবন, তাঁর সময় ও সমকালীন সমাজের নানা ছবি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কিত কিন্তু স্বাপ্নিক, অস্পষ্ট কিন্তু বর্ণাঢ্য এক নাম কর্নেল তাহের। শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্নেল’ বইয়ের কেবল লেখকই নন, বরং তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষকও বটে। রাজনৈতিক চাদরে ঢেকে রাখা একটি চরিত্রকে লেখক পাঠকের দ্বারে টেনে তুলে এনেছেন অপার সাহসিকতা আর সামগ্রিকতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসকে পতিত করে অবিরাম জন্ম দেয়া হয়েছে ধোঁয়াচ্ছন্নতা আর মিথ্যার বেসাতি। লেখক প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মোহ থেকে তুলে ধরেছেন সিনেম্যাটিক অভিযানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগদান করা মুক্তিযোদ্ধা, দুর্ধর্ষ কামালপুর অপারেশনে পা হারানো সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রাচে ভর দেয়া এক স্বাপ্নিক নাগরিক, বিরল আর আপাত ব্যর্থ এক সেপাই অভ্যুথানের নায়ক এবং সর্বোপরি ক্ষুদিরামের পথের অভিযাত্রী কর্নেল তাহের ও সেই ঘোর লাগা সময়ের কুশীলবদের।
প্রজাপতি পলায়ণ ও রক্ত" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: এই দেশে যারা ১৯৭১ এর ভেতর দিয়ে গিয়েছে তারা সারা জীবনের জন্যে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একাত্তরের স্মৃতি বুঝি শুধু মস্তিষ্কে নয়, এটি বুঝি রক্তের মাঝে ঢুকে গেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভেতর প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের প্রজন্ম পৃথিবীর সবচাইতে নৃশংস প্রজাতি পাকিস্তানী মিলিটারির নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং সব চাইতে ঘৃণিত প্রজাতি রাজাকার আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতা নিজের চোখে দেখেছে। খুব সহজেই এই নৃশংসতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা তাদের পুরো মানবজাতির ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সেটি ঘটেনি। তার কারণ একাত্তরের নয় মাস তারা একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর বীরত্ব এবং দেশের সাধারণ মানুষের একের জন্যে অন্যের ভালোবাসাটুকু দেখেছে। স্বাধীনতার আনন্দ কতো তীব্র হতে পারে সেটি শুধুমাত্র এই প্রজন্ম অনুভব করতে পেরেছে আর কেউ নয়। সেই একাত্তরের প্রজন্ম সেলিম সোলায়মানের লেখা 'প্রজাপতি পলায়ন ও রক্ত" বইটির পাণ্ডুলিপিটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। একাত্তরের বিশাল ব্যাপ্তিকে ধারণ করার মতো ক্যানভাস পৃথিবীতে নেই, তাই তার ওপরে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, সেই হিসেবে এই বইটি একটু অন্যরকম, কারণ লেখক একাত্তরটি দেখেছেন একজন শিশু হিসেবে। ছোট একটা শিশু একাত্তরে কেমন করে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে পারে, যখন প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়ানোর কথা তখন কেমন করে রক্ত দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় সেলিম সোলায়মান আমাদের সেই গল্পটি শুনিয়েছেন।
পুলিশ ভেঙে ফেলল ১৯৫২ সালের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলেন ফরিদপুর কারাগার থেকে অনশন ধর্মঘট করার পর। তাঁর আব্বা তাঁকে নিয়ে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই মুজিব জানতে পারলেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মনোভাব—বাঙালিদেরও উর্দু শিখতে হবে। এবার কী করবেন মুজিব? তাজউদ্দীনরা ভাবছেন, একটা আলাদা দল করতে হবে। গণতন্ত্রী দল গঠনের তৎপরতার সঙ্গে খানিকটা যুক্ত থাকলেন তিনি। মওলানা ভাসানী কারাগারে। সেখান থেকে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া, তাজউদ্দীনের আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আর শেখ মুজিবের মন্ত্রিত্ব লাভ এবং মন্ত্রীর বাড়ি থেকে সোজা জেলযাত্রা। তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে রেনুর অকূলপাথারে পড়ে যাওয়া। রাজনীতির ডামাডোল ওলটপালট করে দেয় ব্যক্তিমানুষেরও জীবন। এই রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কেবল একটি দেশের নেতা বা জনগণ নির্ধারণ করে না, তা নির্ধারণের চেষ্টা চলে ওয়াশিংটন থেকেও। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তো তা-ই বলতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের ইচ্ছাই কি জয়ী হয় না?
নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং 'কে' ফোর্স ছিল বেশ তৎপর। সেক্টর এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে চলত বিরামবিহীন অভিযান। এ গ্রন্থে এসব অভিযানের ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন সেক্টর এবং ফোর্স কমান্ডার মেজর (পরে লে. কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। গ্রন্থটি ২ নম্বর সেক্টর এবং ফোর্সের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস। কমান্ডারের বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে যুদ্ধসংশ্লিষ্ট দলিল, ছবি, মানচিত্র এবং আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য। সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডারের কেউ কেউ তাঁদের এলাকার আংশিক বা খণ্ডিত ইতিহাস লিখেছিলেন, কিন্তু মেজর খালেদ রেখে গেছেন ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের খতিয়ান।
'রাজাকার ইজ্জত আলীর জীবনের একদিন' বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। গিয়াস উদ্দিন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে চোখটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে গানটা গাইতে শুরু করল, যখন মনে অশান্তি হয় তখন গান গাইলে তার মনটা শান্ত হয়। এখন তার ভেতরে কষ্ট আর অশান্তি, গলা ছেড়ে সুরটা ধরতে পারলেই সে শান্তি পাবে। গিয়াস উদ্দিন কাঁপা গলায় গাইতে শুরু করে- "দয়াময়, ওরে দয়াময় আমারে যদি লইয়া যাইবা তোমার ধারে তাহলে আমারে জনম দিলা কেনে-" প্রচ্ছদঃ আরাফাত করিম ভূমিকাঃ এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক। তবে যে ঘটনার কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলো সত্যি। ঘটনাগুলো ১৯৭১ সালে আমি নিজের চোখে দেখেছি, শুনেছি কিংবা লোকমুখে জেনেছি। ২০১৮ সালের এই সময়টিতে কেন আমি এই উপন্যাসটি লিখেছি তার একটা কারণ আছে। তবে ঠিক কী কারণ জানা নেই, এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরে এক ধরনের গ্লানি অনুভব করছি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বনানী, ২১ আগস্ট ২০১৮