বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কিত কিন্তু স্বাপ্নিক, অস্পষ্ট কিন্তু বর্ণাঢ্য এক নাম কর্নেল তাহের। শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্নেল’ বইয়ের কেবল লেখকই নন, বরং তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষকও বটে। রাজনৈতিক চাদরে ঢেকে রাখা একটি চরিত্রকে লেখক পাঠকের দ্বারে টেনে তুলে এনেছেন অপার সাহসিকতা আর সামগ্রিকতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসকে পতিত করে অবিরাম জন্ম দেয়া হয়েছে ধোঁয়াচ্ছন্নতা আর মিথ্যার বেসাতি। লেখক প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মোহ থেকে তুলে ধরেছেন সিনেম্যাটিক অভিযানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগদান করা মুক্তিযোদ্ধা, দুর্ধর্ষ কামালপুর অপারেশনে পা হারানো সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রাচে ভর দেয়া এক স্বাপ্নিক নাগরিক, বিরল আর আপাত ব্যর্থ এক সেপাই অভ্যুথানের নায়ক এবং সর্বোপরি ক্ষুদিরামের পথের অভিযাত্রী কর্নেল তাহের ও সেই ঘোর লাগা সময়ের কুশীলবদের।
সরদার ফজলুল করিমের পৃথিবী ছিল নিরন্তর অনুসন্ধানের। বিপুল বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা আর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর জীবন। ফলে দিনপঞ্জিতে লেখা নিত্যদিনের খুব সাধারণ ঘটনার মধ্যেও জীবন-জগৎ আর ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গভীর বোধের পরিচয় পাওয়া যায়। সরদার ফজলুল করিমের দার্শনিক মন সারাক্ষণ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানা জটিল জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে ফিরেছে। আপন জীবন এবং সমকালীন ইতিহাসকে পরিপ্রেক্ষিতে রেখে তিনি দেশ ও সমাজকে উপলব্ধির প্রয়াস করেছেন। সমস্যা আর সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছেন। আবার জীবন বলতেও জীবনের বহুমাত্রিক দিক উঠে এসেছে তাঁর এসব ভাবনালিপিতে। আমার পৃথিবী বইয়ে তাঁর লেখাগুলো ডায়েরি-আশ্রিত। সেগুলোকে দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, দেশ, জীবন, সাহিত্য—এভাবে পর্ববিন্যস্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। সাহিত্য অংশে স্থান পেয়েছে বই ও লেখক নিয়ে তাঁর পাঠানুভূতি। সরদার ফজলুল করিমের চিন্তাজগৎকে বুঝতে বিশেষ সহায়ক হবে বইটি।
নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং 'কে' ফোর্স ছিল বেশ তৎপর। সেক্টর এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে চলত বিরামবিহীন অভিযান। এ গ্রন্থে এসব অভিযানের ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন সেক্টর এবং ফোর্স কমান্ডার মেজর (পরে লে. কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। গ্রন্থটি ২ নম্বর সেক্টর এবং ফোর্সের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস। কমান্ডারের বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে যুদ্ধসংশ্লিষ্ট দলিল, ছবি, মানচিত্র এবং আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য। সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডারের কেউ কেউ তাঁদের এলাকার আংশিক বা খণ্ডিত ইতিহাস লিখেছিলেন, কিন্তু মেজর খালেদ রেখে গেছেন ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের খতিয়ান।
রাত্রি ১২টা। ক্রিং ক্রিং। হাজি মোরশেদ ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো।’ ‘হ্যালো, বলধা গার্ডেন থেকে বলছি।’ ‘আমি শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে বলছি।’ ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। মেশিন কী করব?’ ‘আপনি একটু ধরেন। মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করে আসছি।’ হাজি মোরশেদ দৌড়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ‘মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে, মেশিন কী করবে জানতে চায়।’ মুজিব বললেন, ‘মেশিন ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’ হাজি সাহেব বুঝলেন, বলধা গার্ডেন একটা কোড। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ পাঠানো হয়ে গেল।শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়া চলেছেন বড় একটা লঞ্চ নিয়ে। নদীর দুধারে বিপুল জনতা টের পেয়ে গেছে এই লঞ্চে আছেন তাদের প্রিয়তম বঙ্গবন্ধু। তারা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে আসছে নেতাকে একনজর দেখবে বলে। এই ভালোবাসার জবাব কেমন করে দেবেন মুজিব? আইয়ুব খান বিদায় নিলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। চীন দাবার ঘুঁটি চালছে, আমেরিকা তৎপর। নির্বাচন এল। মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দীন সক্রিয় দেশের সেরা অর্থনীতিবিদ আর আইনবিদদের নিয়ে, ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো রচনায়। ভাসানীর মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না; তিনি স্লোগান দিচ্ছেন, ভোটের আগে ভাত চাই। নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করল আওয়ামী লীগ। ভুট্টোর সঙ্গে লারকানায় পাখি শিকার করার নামে লাখো বাঙালি হত্যার নীলনকশা প্রস্ত্তত করলেন ইয়াহিয়া। এল একাত্তরের মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আলোচনা ভেস্তে গেল। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, সৈনিকদের বঙ্গবন্ধু আদেশ দিলেন, অস্ত্র গোলাবারুদ হাতে নাও, প্রতিরোধ গড়ো। সবাই অনুরোধ করছে, মুজিব ভাই, ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনি পালান। মুজিব হাসছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি পালাব না। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দেশকালের ছবি আঁকা রইল এই উপন্যাসে।
প্রজাপতি পলায়ণ ও রক্ত" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: এই দেশে যারা ১৯৭১ এর ভেতর দিয়ে গিয়েছে তারা সারা জীবনের জন্যে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একাত্তরের স্মৃতি বুঝি শুধু মস্তিষ্কে নয়, এটি বুঝি রক্তের মাঝে ঢুকে গেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভেতর প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের প্রজন্ম পৃথিবীর সবচাইতে নৃশংস প্রজাতি পাকিস্তানী মিলিটারির নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং সব চাইতে ঘৃণিত প্রজাতি রাজাকার আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতা নিজের চোখে দেখেছে। খুব সহজেই এই নৃশংসতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা তাদের পুরো মানবজাতির ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সেটি ঘটেনি। তার কারণ একাত্তরের নয় মাস তারা একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আর বীরত্ব এবং দেশের সাধারণ মানুষের একের জন্যে অন্যের ভালোবাসাটুকু দেখেছে। স্বাধীনতার আনন্দ কতো তীব্র হতে পারে সেটি শুধুমাত্র এই প্রজন্ম অনুভব করতে পেরেছে আর কেউ নয়। সেই একাত্তরের প্রজন্ম সেলিম সোলায়মানের লেখা 'প্রজাপতি পলায়ন ও রক্ত" বইটির পাণ্ডুলিপিটি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। একাত্তরের বিশাল ব্যাপ্তিকে ধারণ করার মতো ক্যানভাস পৃথিবীতে নেই, তাই তার ওপরে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, সেই হিসেবে এই বইটি একটু অন্যরকম, কারণ লেখক একাত্তরটি দেখেছেন একজন শিশু হিসেবে। ছোট একটা শিশু একাত্তরে কেমন করে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে পারে, যখন প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়ানোর কথা তখন কেমন করে রক্ত দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় সেলিম সোলায়মান আমাদের সেই গল্পটি শুনিয়েছেন।