১৯৭২ সালে যুদ্ধজয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন ধর্ষিত নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করেছেন। অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ডোরা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান যাঁকে আমরা মিহির নামে জানতাম তাঁদের শরনাপন্ন হই। উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ আমাদের করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি।পরে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে নারকীয় বর্বরতার কাহিনী জানতে পারি। সেই থেকে বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে। নানা সময়ে দিনপঞ্জিতে এঁদের কথা লিখে রেখেছিলাম। ইচ্ছা ছিল, জনসমাজের এঁদের পরিচয় তুলে ধরার। এ ক্ষুদ্র গ্রন্থ সে আগ্রহেরই প্রকাশ। এখানে একটি কথা অবশ্য উল্লেখ। চরিত্রগুলি ও তাঁদের মন-মানসিকতা, নিপীড়ন, নির্যাতন সবই বস্তুনিষ্ঠ। তবুও অনুরোধ অতি কৌতূহলী হয়ে ওদের খুঁজতে চেষ্টা করবেন না। এ স্পর্শকাতরতা আমাদের অবহেলা এবং ঘৃণা ও ধিক্কারের দান। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত করছিলাম। প্রকাশে শঙ্কা ছিল। কিন্তু আমার স্নেহভাজনীয় ছাত্রী কল্যাণীয়া বেবী মওদুদ উৎসাহ, প্রেরণা ও তাঁর অদম্য কর্মক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে এলেন। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলার জন্য ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ ১ম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ভীত কম্পিত হস্তে, সংশয় শঙ্কাকূল চিত্তে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু না, প্রজন্ম একাত্তর এই দেশপ্রেমিক রমণীদের মাতৃসম্মানে সমাদৃত করেছে। তারা জানতে চেয়েছে সেই সাহসী বীরাঙ্গনাদের কথা। তাই সাহসের ভর করে এগুলাম। অনেকে সংবর্ধনা ও সম্মান জানাবার জন্য এঁদের ঠিকানা চেয়েছেন। তার জন্য আরও একযুগ অপেক্ষা করতে হবে। যদি জীবনে সময় ও সুযোগ পাই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের বাসনা রইল ধর্মান্ধতার কালিমা দূরীভূত করতে। আমার প্রকাশকের সঙ্গে অগণিত পাঠকের প্রতি রইলো সকৃতজ্ঞ শুভেচ্ছা। নীলিমা ইব্রাহিম
'রাজাকার ইজ্জত আলীর জীবনের একদিন' বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। গিয়াস উদ্দিন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে চোখটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে গানটা গাইতে শুরু করল, যখন মনে অশান্তি হয় তখন গান গাইলে তার মনটা শান্ত হয়। এখন তার ভেতরে কষ্ট আর অশান্তি, গলা ছেড়ে সুরটা ধরতে পারলেই সে শান্তি পাবে। গিয়াস উদ্দিন কাঁপা গলায় গাইতে শুরু করে- "দয়াময়, ওরে দয়াময় আমারে যদি লইয়া যাইবা তোমার ধারে তাহলে আমারে জনম দিলা কেনে-" প্রচ্ছদঃ আরাফাত করিম ভূমিকাঃ এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক। তবে যে ঘটনার কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলো সত্যি। ঘটনাগুলো ১৯৭১ সালে আমি নিজের চোখে দেখেছি, শুনেছি কিংবা লোকমুখে জেনেছি। ২০১৮ সালের এই সময়টিতে কেন আমি এই উপন্যাসটি লিখেছি তার একটা কারণ আছে। তবে ঠিক কী কারণ জানা নেই, এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরে এক ধরনের গ্লানি অনুভব করছি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বনানী, ২১ আগস্ট ২০১৮
গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে কেন পাকিস্তান একটি একক রাষ্ট্র ছিল না, ১৯৭০-এর নির্বাচন কোন সংকট সৃষ্টি করে এবং কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান তার চরম সংকট সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, দখলকৃত বাংলাদেশে তারা নয় মাস কী কী প্রচেষ্টা নেয়, পরিস্থিতি সামলাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ক্রিয়াকর্ম, যা শেষে ব্যর্থ হয় এসবের আলোচনা। এ ছাড়া আছে কীভাবে পাকিস্তানের কার্যক্রম মিডিয়াতে এসেছে, হামুদুর রহমান কমিশনের মূল বক্তব্য, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভ,মিকা নিয়ে তদন্ত করে পাকিস্তান সরকার তার রিপোর্ট এবং সেই সময়ের প্রতিবাদী পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকার। শেষে রয়েছে নির্বাচিত প্রামাণিক দলিল ও নয় মাসের ঘটনা।
পাকিস্তানী শাসনের শেষ কয়দিনে ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশায় জেনারেল রাও ফরমান আলী জড়িত ছিলেন কি না এবং থাকলে কতখানি জড়িত ছিলেন তার তদন্ত হয়নি। তবে তদানীন্তন পাকিস্তানী সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান হিসেবে তার জড়িত থাকাটা আস্বাভাবিক নয়। তাই বাঙালীর কাঠগড়ায় রাও ফরমান আলী কতখানি অপরাধী সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় বরণ করার জন্যে পাকিস্তানী জনগণের কাঠগড়ায় তখনকার জেনারেলদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই অপরাধ ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি নিষ্কৃতি পেতে অনেক জেনেরেলই আত্মজীবনীতে একাত্তরের যুদ্ধে নিজেদের দোষ ও ভুল-ত্রুটিগুলো ঢাকতে এবং সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছেন। রাও ফরমান আলীও তার ব্যতিক্রম নন। এসব লেখায় তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনাই এসেছে এবং জেনারেলরা নিজেদের সুবিধামতো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সব কারণে পাকিস্তান হেরেছিল, সেসব অনেক ভুল ও দোষ পরস্পরের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর How Pakistan Got Divided বইটি রচনাশৈলী বিন্যাসের দিক থেকে অন্য জেনারেলদের চাইতে অনেক উন্নত। বইটি তিনি কেন লিখেছেন এ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী খানের ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেয়েছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশী দেখেছি।” কী দেখেছেন রাও ফরমান আলী খান? বইটিতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তাও কতখানি সত্য? রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসভাজন মনে হবে। এ কৌশল তাঁর জন্য অবশ্যই ভালো। কিন্তু ইতিহাস বা ভবিষ্যতের জন্য তা ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানের জনগণ অথবা অন্যান্য দেশের পাঠকের বইটি পড়ার সুযোগ হলেও বাংলাদেশের জনসাধারণের হয়তো সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই বইটিতে রাও ফরমান আলী যুদ্ধের নীতি নির্ধারণে পাকিস্তানী পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হারার বিষয়ে কীভাবে সাফাই গাইছেন পাঠক তা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হতে পারবেন। অনূদিত এই গ্রন্থটিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর দীর্ঘ ভূমিকায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এ বই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠবে, বেরিয়ে আসবে অনেক সত্য। অগোচরে থেকে যাওয়া ইতিহাসের সে সকল সত্য নিয়ে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রাও ফরমান আলী খানের উপস্থাপিত তথ্যের চ্যালেঞ্জ করার জন্য অনেকে এগিয়ে আসবেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উপাত্ত উপাদান ও গবেষণা হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ।
পুলিশ ভেঙে ফেলল ১৯৫২ সালের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলেন ফরিদপুর কারাগার থেকে অনশন ধর্মঘট করার পর। তাঁর আব্বা তাঁকে নিয়ে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই মুজিব জানতে পারলেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মনোভাব—বাঙালিদেরও উর্দু শিখতে হবে। এবার কী করবেন মুজিব? তাজউদ্দীনরা ভাবছেন, একটা আলাদা দল করতে হবে। গণতন্ত্রী দল গঠনের তৎপরতার সঙ্গে খানিকটা যুক্ত থাকলেন তিনি। মওলানা ভাসানী কারাগারে। সেখান থেকে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া, তাজউদ্দীনের আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আর শেখ মুজিবের মন্ত্রিত্ব লাভ এবং মন্ত্রীর বাড়ি থেকে সোজা জেলযাত্রা। তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে রেনুর অকূলপাথারে পড়ে যাওয়া। রাজনীতির ডামাডোল ওলটপালট করে দেয় ব্যক্তিমানুষেরও জীবন। এই রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কেবল একটি দেশের নেতা বা জনগণ নির্ধারণ করে না, তা নির্ধারণের চেষ্টা চলে ওয়াশিংটন থেকেও। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তো তা-ই বলতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের ইচ্ছাই কি জয়ী হয় না?
সিলেট-তামাবিল রাস্তার মাইল চারেকের মধ্যে নন্দীছড়া চাবাগান। সেই বাগানের ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমদ হলেন আরিফের প্রিয় ছােট মামা। তিনি সিলেটে তাদের বাসায় বেড়াতে গেলেই হইচই পড়ে যায়। তার জন্য পাত্রী খােজা হচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যেই এসে পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। তার আগুন আর উত্তাপ নিয়ে। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে পাকিস্তানিরা যখন কাপুরুষের মতাে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঙালিদের ওপর, ইমতি মামা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তার এক বন্ধু রােমানও যােগ দিলেন তার সঙ্গে। মার্চ শেষ হয়ে এপ্রিল এলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকল । আরিফের মা, বড়ভাই আনিস আর বােন রামিসা গেলেন একদিকে, আরিফ গেল রােমান মামার সঙ্গে নন্দীছড়া, তার সঙ্গে গেল তার প্রিয় কুকুর কালু। আরিফের বাবা থেকে গেলেন সিলেটে। পেশায় তিনি ডাক্তার, রােগীর কথা তাকে মনে রাখতে হয়। নন্দীছড়ায় দু’মাসের মতাে থাকল আরিফ, সেই বাগান ও একটু দূরের আলিপুর বাগানের তার বয়সী। চারজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হলাে। দুমাস ধরে অনেক ঘটনা ঘটল। মে মাসের ৩০ তারিখ সকলে মিলে বাগান ছেড়ে গেলেন সীমান্তের দিকে। দুই দল হয়ে চিকন বিল পার হয়ে তারা গেলেন উত্তরে। কিন্তু আরিফ ও তার বন্ধুরা পড়ল শত্রুদের সামনে। তাদের সঙ্গে ছিলেন বাগানের এক কর্মকর্তার স্ত্রী মায়া, আরিফদের মায়া আপা। আরিফ সাহসের সঙ্গে, বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ করল। শত্রুদের মােকাবেলা করল, বাংলাদেশে কিছু যে পাকিস্তান-ভক্ত ছিল তাদেরও। নন্দীছড়ার এই যােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বর্ণনা আছে এই বইটিতে, আছে মুক্তিযুদ্ধ কেন হলাে, তার একটা ব্যাখ্যা। রুদ্ধশ্বাস বর্ণনায় এই ক্ষুদে যােদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের গল্প । নন্দীছড়ার যােদ্ধারা। |