মুক্তিযুদ্ধ : কিশাের উপন্যাসমালা নবীন প্রজন্মের হাতে ভুলে দেওয়া হচ্ছে সেই অবিশ্মরণীয় দিনগুলাের হৃৎপন্দন তাদের মধ্যে সঞ্চারের লক্ষ্যে। নবীন প্রবংশের লেখক, একাত্তর যাদের স্মৃতিতে নেহায়েতই বাল্যের অস্পষ্ট অভিঘাতের মতাে জেগে রয়েছে, যুদ্ধদিনে ফিরে গিয়েছেন অন্তরের উদগ্র তাগিদ থেকে এবং রচনা করেছেন কিশাের যােদ্ধার অনুপম কাহিনী। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে স্মরণীয় উপন্যাস 'রেড ব্যাজ অব কারেজ' রচনা করেছিলেন। স্টিফেন ক্রেন, যুদ্ধের কোন প্রত্যক্ষ স্মৃতি যার ছিল না। বাঙালির বীর গাথা নিশ্চিতই সঞ্চারিত হবে আগামীদিনের নাগরিকদের মধ্যে, সেই প্রত্যয়ের স্বাক্ষর বহন করছে। সেজান মাহমুদের বই। একাত্তরের এই কাহিনীর হাত ধরে কিশাের পাঠকরা পৌছে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে, দূর অতীত আবার হয়ে উঠবে সজীব বাস্তব এবং শুধু তথ্য হিসেবে জানা নয়, হৃদয়-মন দিয়ে তারা বুঝতে পারবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনীর বিশ্বস্ত অনুলিপি। রচয়িতা নিজেই এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী - ১ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে তিনি তাঁর সেক্টরে দীর্ঘ ন'মাস সেই রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' লেখকের মূল গ্রন্থ এ টেল অব মিলিয়নস" এর অনুবাদ,এ টেল অব মিলিয়নস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ এবং এর বাংলায় অনুদিত 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' একই সাথে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের এই মূল্যবান গ্রন্থটিতে রয়েছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্ভব, বিকাশ, হতাশা, বেদনা, আনন্দ আর বিজয়ের সত্যনিষ্ঠ অবিস্মরণীয় ধারা বিবরণী। এ গ্রন্থে বর্ণিত আছে কিভাবে একটি শান্তিপ্রিয় জাতি যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিত, শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে শেষ পর্যন্ত এক ও অভিন্ন রূপে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৃশংস ও বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ইস্পাত-কঠিন বন্ধন থেকে ছিনিয়ে এনেছিল প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। গ্রন্থাকার মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা অস্পষ্ট দিকগুলো ভাস্বর করে তুলেছেন।, নির্ভয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। তিনি বর্ণনার সাথে ঘটনার যথার্থতা ও সত্যতা সম্পর্কেও অতি সচেতন বলে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভুলতার মূল্যায়নে উত্তীর্ণ এই গ্রন্থ। তাই ১৯৮১ সালের সংসদেও মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসাবে বহুল আলোচিত হয়। সংকীর্ণ স্বার্থ ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রয়াসে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস বিকৃত, অস্পষ্ট ও ঝাপসা হয়ে যাবার পূর্বেই মুক্তিযুদ্ধের এক অগ্রণী সৈনিকের সচেতন প্রয়াসে রচিত এই গ্রন্থ আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের এক বিশ্বস্ত দলিল।'
প্রথম অধ্যায়ে দেশ ও জনগােষ্ঠির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যে দেশের ইতিহাস আমরা পড়ছি অর্থাৎ বাংলাদেশের এবং বাঙালির, তার একটি পরিচিতি দরকার। এটি না জানলে নিজেকে জানা হয় না। এ অধ্যায়ে আমরা এ দেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আলােচনা করেছি। যে বিষয়টিতে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে তা হলাে এই ভূপ্রকৃতি প্রাচীন কাল থেকে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং কীভাবে তা বাঙালি মানস গঠনে প্রভাব ফেলেছে। আলােচিত হয়েছে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষা।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের জয় পরাজয় বইটির রচনাগুলিতে চোখ ফেললেই বোঝা যায়, এ দেশের জনসাধারণ নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুক্তির জন্যে মরণপণ যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের সেই মুক্তি ঘটেনি। স্বাধীনতার স্বাদ এ দেশের কল্যাণকামী জনগণ পায়নি। কারণ যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলা হয়, সেই দলেরই হাতে এ দেশের মানুষের প্রায় সমস্ত আকাক্সক্ষা দলিত ও ধূলিসাৎ হয়েছে। বইটির পরতে পরতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনব্যবস্থা এ দেশের জনগণের দুশমনেরই কাণ্ডকারখানা। মানুষকে পঙ্গু করে রাখার সব ধরনের আয়োজন কায়েম করে রাখা হয়েছে এখানে। এ ব্যাপারে অন্ধ থাকলে চলবে না- এটাই এ বইয়ের আসল কথা।
সবুজ ঘাসের ওপর জমাট বেঁধে আছে রক্ত। কারও রক্ত। আবার মিশে গেছে বেলাইয়ের স্বাচ্ছ জলে। এখানে সেখানে পড়ে আছে শিয়াল-কুকুরে খাওয়া অসংখ্য বীভৎস শরীর। দাউদাউ পুড়ছে বাড়ি-ঘর। বাতাসে কেবলই লাশের গন্ধ। ১৯৭১ সাল ১৪ মে শুক্রবার দুপুর ১টার মিনিট দশেক আগে হঠাৎ করেই পাকিস্তানি বাহিনী। আক্রমণ করে বাড়িয়া এলাকায়। মিশন মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় হিন্দু অধ্যুষিত গাজীপুরের বাড়িয়া। তিন দিকে বেলাই বিলে বেষ্টিত বাড়িয়ায়। নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা। বিল সাঁতরে কিংবা নৌকায় চড়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন শত শত নারী-পুরুষ আর শিশু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নৃশংসতম এই গণহত্যার ঘটনায় কতজন প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি। তবে পাকিস্তানি নরপশুদের হত্যা শিকারের উল্লাসের নিচে শহীদ হন অন্তত দুশ মানুষ। এদের কারোই ঠাই হয় নি স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে। শ'খানেক শহিদের একটি নামের তালিকা ধরে প্রায় ৩ বছর অনুসন্ধানের পর গ্রন্থভুক্ত হলো বাড়িয়া গণহত্যা। বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শহিদ হওয়া সেই সকল নারী-পুরুষ ও শিশুদের নানা অজানা অধ্যায় ও বীভৎস সেই ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। এই গ্রন্থের প্রতিটা পাতাই ভেজা। প্রতিটা শব্দেই যেন লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। প্রতিটা বাক্যই সাক্ষ্য দিচ্ছে-বইটা যেন একাত্তরের বধ্যভূমি।
যে সীমাহীন ত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এসেছিল,তা মানুষের মনে কী স্বপ্ন জন্ম দিয়েছিল, বাস্তবে তাঁরা কী পেলেন, এবং কোন আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কোন পথে গেল সেই বাংলাদেশ- সে সম্পর্কে নিরপেক্ষ ইতিহাস দুর্লভ। এ বইতে লেখক মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপরের বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।