আমার বাবা ছিলেন একজন নেশাদার পাখি শিকারি। সরকারি চাকরি করতেন তিনি। চাকরিসূত্রে যেখানেই থাকতেন, মূল্যবান বন্দুকটা সেখানেই রাখতেন। মায়ের কাছে শুনেছি আমি, ঘুমের ভেতরও বাবা পাখি শিকার করতেন এবং চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসতেন, 'পাখি পাখি, মানিকজোড়-মদনটাক-গগনবেড় পাখি'। তাঁর ভাগ্যটাও পক্ষে ছিল। সারা জীবন চাক্রি করেছেন সুন্দরবন ঘেষাঁ শরণখোলা, রায়েন্দা, মোরেলগঞ্জ, চালনা (মংলা), দাকোপ, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা), মোল্লাহাট ও ফকিরহাটে। যেখানেই তিনি ছিলেন, সেখানেই জুটিয়ে নিয়েছিলেন শিকারি বন্ধুদের। এমনকী চাক্রির মায়া ত্যাগ করেও শিকারে বেরুতেন তিনি। সুন্দরবনে ঢুকতেন চোরা শিকারি বন্ধুদের সাথে, শিকার করতেন হরিণ, বনমোরগ, সুন্দরী হাঁস, মদনটাক, মানিকজোড় পাখি। বাল্য-কৈশোরে তাঁর সাথে সুন্দরবনে শিকারে যাবার সুযোগ আমার বহুবার হয়েছিল। বাবার বন্দুকটা ছিল ইংল্যান্ডের। বাবার টার্গেটও মিস হতো না সহজে। বন্যপ্রাণী আইন তখনো ছিল, কিন্তু কড়াকড়ি ছিল না মোটেই। সুন্দরবনের নেশাটা তাই আমাকেও পেয়ে বসেছিল ভালভাবে। তাই সুযোগ পেলে এমনকী স্কুল কামাই করেও আমি চলে যেতাম শরণখোলা বা মোরেলগঞ্জে। বাবা হাসতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ চোরা শিকারি বন্ধু (আমার শিকারি কাকা) বুঝে ফেলতেন আমার মতলবটা।
গভীর সমুদ্রের নিচে নিকম কালো অন্ধকার। সূর্যের আলো সেখানে পৌছায় না। সেই ঘন অন্ধকারে দেখা যায় আলােজুল মাছদের। এদের বলে দীপক মাছ। সমুদ্রের ২০০ থেকে ৭০০ মিটার গভীরতায় এই ধরনের মাছ দেখতে পাওয়া যায়। সমুদ্রের নিচের নিকক্ষ অন্ধকারের মাঝে বিচিত্র আকৃতির প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়। তাদের একটি। হলাে আলােড়লা মাছ। এদের দেখলে মনে হয় আলাের বাতি জ্বালিয়ে ঘুরছে মাছগুলাে। আলাের মালা যেন ভাসছে। এসব মাছদের চোখের নিচে, পেটের নিচে এবং লেজের কাছে আলাে জ্বলতে দেখা যায়। ঘন অন্ধকারে খাদ্য শিকারের জৈবিক প্রয়ােজনেই তাদের দেহে এমন করে আলাে জ্বলে।
"অপরাজিতা ফুলের মত ঝকঝকে নীল আকাশে সাঁই সাঁই ডানা মেলে দিয়ে অবিরাম উড়তে থাকে কত ধরনের পাখি। তাদের পাখসাটে পরিবেশ মুখরিত হয়। সোনালি রোদের আলোতে তাদের পালকগুলো ঝিকিয়ে ওঠে। গাছের শাখায় বসে কিচির মিচির করে তারা বুঝি ঝণ্ডার তোলে। উড়াল দিয়ে কত দূরে চলে যায় পাখিরা। বাতাসে যখন শীতের ছোঁয়া লাগে তখন বহু দূরের পথ পেরিয়ে এদেশে বিল-হাওরে চলে আসে পরিযায়ী পাখিরা । হিমশীতল দেশ থেকে তারা আসে। জলজ উদ্ভিদের মাঝে তাদের অবাধ ওড়াওড়ি। এমনিভাবে এক নিবিড় রহস্যের ভূবন গড়ে তোলে পাখিরা। আমাদেরকে চারপাশে সে রহস্যের কাঁপন যায় ছড়িয়ে। ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানার চিলের করুণ ডাক শুনে অনেকেই উদাসী হয়। লোক কবি আকুল হয়ে লেখেন- ’উইড়া যায়বে হংস পঙ্খি পইরা রয়বে ছায়, দেশের বন্ধু দেশে যাইব কে করিবে মায়া।’ দোয়েলের জীবন জানতে আগ্রহী হয় কেউ। জলপায়রাদের ঝাঁক গাঙ পেরিয়ে ধূধূ চরে যায়। এইতো পাখিদের নিবিড় আশ্চর্য, সুন্দর জগত। আর এভাবেই বুঝি পাখিরা আমাদের আয়েসে জানিয়ে দেয় ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...’ পাখিদের বিচিত্র ভুবনকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন লেখক। পাখিরা যেন তার কাছে তাদের জীবনের রহস্য প্রকাশ করেছে। লেখক সর্বদা কান পেতে থাকেন পাখিদের ডাক শোনার জন্য । পাখিরা তাকে বেঁচে থাকার আনন্দের আস্বাদ দিয়েছে। ‘পাখিদের নিয়ে’ সেই কথকতায় পূর্ণ।"
"১৯৯৪ সালে যখন দ্বিজেন শর্মার 'গহন কোন বনের ধারে' বই আকারে বেরিয়েছিলো তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র আমি। তখনও তিন গোয়েন্দার সন্ধানই পাই নি, দ্বিজেন শর্মার এই বইয়ের সন্ধান পাওয়া তো বাতুলতা। পড়ার গন্ডি তখন কেবল ইত্তেফাকের 'টারজান' কার্টুনে এসে পৌঁছেছে। আরো দুই বছর পরে ক্লাস সিক্সে উঠে সর্বপ্রথম মহস্বল শহরের একমাত্র পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই; 'আউট বই' পড়ার বদঅভ্যাসের গোড়াপত্তন এখান থেকেই। 'গহন কোন বনের ধারে'-এর প্রথম প্রকাশের প্রায় দুই দশক পরে দিন কয়েক আগে যখন বইটি পড়ি, তখন লেখার ঢং দেখে বুঝতে কষ্ট হয় নি এই বই মূলত আরো বছর তেরো আগেই হাতে পাওয়া উচিত ছিলো। কিশোর-তরুণদের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে আগ্রহী করার নৈতিক তাড়না থেকেই বইটি প্রকাশ করেছিলেন লেখক। বিজ্ঞানের খটখটে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত লেখক এমন মমত্ব মিশিয়ে স্বকীয় স্টাইলে উপস্থাপন করেছেন যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। ফলে ঠিক যে বয়েসের উপযোগী করে বইয়ের লেখনী- সে বয়স বহু আগে পেছনে ফেলে বহুদুর পথ চলার পরও বইটি শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাই নি, যেন এক নিমিষে ফিরে গিয়েছিলাম ফেলে আসা কৈশোরে। মোট তিনটি আলাদা স্বাদের লেখা নিয়ে এ বই। প্রথম লেখা 'সুদূর কোন নদীর পারে'-তে ছোটখাটো একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মোড়কে পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টির আদিপর্ব, বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি, ওজনস্তরের বিপর্যয়, বিগত শতাব্দীগুলোতে পরিবেশদূষণের তুনলনামূলক মাত্রা, ফুকুয়োকার চাষপদ্ধপদ্ধতি ইত্যাদি চমকপ্রদ বিষয়সমূহ আলোকপাত করা হয়েছে। বইয়ের মূল চরিত্র 'তজব তরফদার' প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক, যিনি প্রকৃতি- পরিবেশ সম্পর্কে বেশ সচেতন। তবে এ গল্পকে 'নির্ভেজাল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী' বলতে লেখক নিজেই অনেকটা সন্দিহান; কেননা গল্পে যে 'সুদূর কোন নদীর পারে'র কথা বলা হয়েছে লেখন সেখানে বিচরণ করেছিলেন ১৯৬৫ এর শীতকালে। আর গল্পে এখানে বিচরণ করতে গিয়েই লেখকের সাথে পরিচয় ঘটে অদ্ভুত চরিত্র 'তজব তরফদার'-এর। ... গল্পচ্ছলে কত-শত অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-তথ্যের সন্ধান পায় আমাদের কিশোর মন!"