বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ একজন প্রবাদপুরুষ। জীবন্ত কিংবদন্তি। চার দশক ধরে লিখছেন অবিরাম। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণ উপাখ্যান, আত্মজৈবনিক, রম্যরচনা কিংবা শিশুতোষ রচনা-সৃষ্টিশীলতার যে মাধ্যমটিতেই হাত দিয়েছেন, অন্য এক আলোর দ্যুতিতে তা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। পাঠকরা তাকে গ্রহণ করেছেন গভীর ভালোবাসায়। পাঠকপ্রিয়তায় সমকালীন বাংলা সাহিত্যে তার মতো তুংগস্পর্শী কাউকে আমরা লক্ষ করি না। কৈশোরে 'জোছনার ফুল- সৌন্দ্রর্যে মুগ্ধ এই শব্দশিল্পীর দেহে বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ। প্রকৃতি জীবনের সৌন্দর্য সন্ধানে যিনি নিবেদিত, কর্কট রোগের কী সাধ্য তাকে হার মানায়! ভূমিকাঃ এই গ্রন্থের সব লেখাই নিউইয়র্কে বসে লেখা। লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থেকে কেমোথেরাপি নামক চিকিৎসার যন্ত্রণা ভোলার চেষ্টা। এই চেষ্টা খুব যে কাজ করেছে তা না, প্রায়ই কলম ছুড়ে ফেলে বিছানায় চাদর মুড়ে শুয়ে ভেবেছি-'আর কত?' যাই হোক, বেশ কিছু লেখা লিখেছি, প্রথম আলো গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে। মতি তাতে বিস্মিত এবং অভিভূত। মনে হয়েছে আমার লেখক-জন্ম সার্থক। এই গ্রন্থে তিনটি গল্পও আছে। গল্পগুলো লিখে আনন্দ পেয়েছে। কঠিন ব্যাধি শরীরে নিয়ে আনন্দ পাওয়া বিস্ময়কর ব্যাপার। বিস্ময়কর এই ব্যাপারগুলো আমার জীবনে ঘটছে। কেন ঘটছে, কে ঘটাচ্ছেন, তা জানি না। জানতে ইচ্ছে করে। হুমায়ূন আহমেদ জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক
হুমায়ূন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়।সাবলীল ঘটনার বর্ননা আর সহজ ভাষায় লেখার কারণে হুমায়ুন আহমেদের বই এর তুলনা নেই। হুমায়ূন আহমেদ একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও হুমায়ূন আহমেদ সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। হুমায়ুন আহমেদের বইসমূহ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। সত্তর দশকের শেষভাগে থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। হুমায়ূন আহমেদ এর সৃষ্ট হিমু ও মিসির আলি চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে।তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলোও সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস হলো নন্দিত নরকে, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া ইত্যাদি। তাঁর নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। নবীজি (২০১২) হুমায়ুন আহমেদের অপ্রকাশিত ও অসমাপ্ত বই।
ফ্ল্যাপে লিখা কথাঃ লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে আমার শরীর চিত হয়ে আছে। গায়ে আমার কোনো কাপড় নেই। টেবিল থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। ঘরের জানালা আছে। জানালায় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নোংরা। সেখানে কিছু বড় বড় নীল রঙের মাছি বসে আছে। মাছিগুলো কিছুক্ষণ বসে থাকে আবার ওড়াউড়ি করে পর্দার ওপর বসে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটায় চুনকাম করা হয়েছে। সেখানে কেউ নোংরা কথা লিখেছে। ভূমিকাঃ প্রথম আলো ঈদসংখ্যার জন্য যখন আমি এই উপন্যাস লিখি, তখন ক্যান্সার নামক জটিল ব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। এই খবরটা আমি জানি না। ক্যান্সার সংসার পেতেছে কোলনে, সেখান থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার অবচেতন মন কি এই খরবটা পেয়েছে? আমার ধারণা পেয়েছে। যে কারণে আমি উপন্যাস ফেঁদেছি একজন মৃত মানুষের জবানিতে। উপন্যাসে এক মহিলার কথা আছে, যার হয়েছে কোলন ক্যান্সার। সেই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। বাসা বেঁধেছে লিভারে, ফুসফুসে। হঠাৎ এইসব কেন লিখলাম? জগৎ অতি রহস্যময়। হুমায়ূন আহমেদ জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক যুক্তরাষ্ট্র
মিসির আলি খুব সাধারণ একজন মানুষ। সাধারণ এবং বিশেষত্বহীন। থাকেন একা। নিজে রেঁধে খান। রোজই এক তরকারি। চাল-ডাল এবং সবজির খিচুড়ি । রান্না তেমন ভালো হয় না, তারপরেও খুব তৃপ্তি করে খান। তাঁর গান শোনার খুব শখ ছিল। একবার কিছু টাকা পেয়ে বেশ দামি ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিলেন। যেদিন কিনলেন তা পরদিনই ক্যাসেট প্লেয়ারটা চুরি হয়ে গেল। চোর কী মনে করে যেমন ক্যাসেটগুলি নেয় নি। এখন মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখা যায়- ক্যাসেট হাতে নিয়ে চুপচপাপ বসে আছেন। কল্পনায় গানগুলি শোনার চেষ্টা করছেন। এই সময় তিনি সামান্য মাথাও দোলান। এর থেকে মনে করা যেতে পারে কল্পনায় গানগুলি শুনে তিনি খুব আনন্দ পাচ্ছেন। আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই সাধারণ বিশেষত্বহীন মানুষটির কিছু গল্প আপনাদের শোনাতে পেরেছি। সাধারণ মোড়কে মোড়া এমন অসাধারন একজনের গল্প বলতে আমার কিছু সমাস্যাও হয়। বারবার মনে হয়-আমি মানুষটির কথা ঠিক ঠিক বলতে পারছি তো? ভুল হচ্ছে না তো? যে প্রগাঢ় মমতা তিনি মানুষের জন্যে লালন করেন তা খানিকটা হলেও উঠে আসছে তো? মানুষটির প্রতি আমর নিজের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা আমি কি পারছি ঠিকঠাক প্রকাশ করতে?
হেমা এক পা এগিয়ে নয়নের গা ঘেঁষে দাঁড়াল । তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “জগতের প্রতিটি মানুষই তার বুকের ভেতর একান্ত নিজস্ব কিছু কষ্ট বয়ে বেড়ায়। সেই কষ্ট সে আর কারও কাছেই বলতে চায় না। কিংবা পারে না। কারণ সে জানে, তার এই কষ্ট বুঝবার ক্ষমতা সে ছাড়া আর কারও নেই । আর কেউ তার ওই অনুভূতি ছুঁতেও পারবে না । হয়তো এ কারণেই হাজার হাজার মানুষের ভিড়েও মানুষ আসলে দিনশেষে একাই । তাই না ?' নয়নের হঠাৎ কী হলো কে জানে! সে আচমকা হেমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে লাগল শিশুর মতো । হেমা মুহূর্তকাল স্থবির দাঁড়িয়ে রইল । তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন কাঁদতে থাকা এই মানুষটাকে সে এর আগে কখনো দেখে নি । তার সঙ্গে পরিচয়ের এই দীর্ঘ ছয় বছরেও না । কী এমন গোপন দুঃখ এই মানুষটার ? কী হয়েছে তার ? হেমা জানে না । তবে সে শক্ত করে নয়নকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল । আচ্ছা, ক্রন্দনরত ওই মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও কি কাঁদছে ?