রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগ্রাম নিয়ে দেশে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও গ্রন্থ প্রকাশিত কম হয়নি। এসমস্ত গ্রন্থে আদিবাসীদের ভূমিকা বা অবদানের কথা তেমন তুলে ধরা হয়নি। অথচ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে আদিবাসীদের ভূমিকা অসীম। ইংরেজ সহ দেশি-বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের শুভ সূচনা করে আদিবাসীরা। এসবরে মধ্যে ছিল পতিতাল বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ। আরো আছে নাচোল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, নানকার সায়েনন, ভানুবিল বিদ্রোহ। এসমস্ত বিদ্রোহ সংগ্রামে আদিবাসীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান অসামান্য। অসংখ্য আদিবাসী সন্তান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে লড়াই করেছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। তাঁদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে। কিন্তু সে কথা রয়েছে অজানা। তাই আদিবাসীদের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয়েছে 'আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা' নামক গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে আছে শহীদ ফাদার লুকাশ মারাতি এবং পার্বত্য এলাকার মং রাজার বীরত্বের কথাসহ কয়েকশত আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন ও যুদ্ধের কথা। ইতিহাসের গবেষকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গ্রন্থটি থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাবেন। বইপ্রেমী সাধারণ পাঠকদেরও উপকারে আসবে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিষয় তথ্যানুসন্ধানীদের জন্য আকর গ্রন্থ হিসেবে এটি সমাদৃত হবে বলে আশা করি।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে—এই অর্জন সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ নয় মাসের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের কারনে। এই শ্বাসরুদ্ধকর মুক্তিযুদ্ধে যিনি অফুরান শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সীমাহীন ত্যাগ, অপরিমেয় দেশপ্রেম আর নিরন্তর সংগ্রামের ফলেই বাঙালির ওপর বিজয়ের আলো ফুটেছিল। স্বাধীনতার পর তিনি যখন দেশকে সব দিক দিয়ে পুনর্গঠনের কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই কিছু বিশ্বাসঘাতক তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনা যে বাঙালির জন্য কত বড় বেদনার, শোকের ও কলঙ্কের তা বর্ণনাতীত । বঙ্গবন্ধু আজও মানুষের অনুপ্রেরণা। শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও। তাঁর কর্ম, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর স্টাইল অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে বিশ্বনেতাদের কাছে। তাঁকে উপাধি দেয়া হয়েছে ‘রাজনীতির কবি' হিসেবে। লেখক বিভিন্ন সময়ে কলমের কালিতে ভাবনা মিশিয়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ও বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো সংগ্রহ করে এক মলাটে বন্দি করা হয়েছে এই গ্রন্থে। আশা করি পাঠকের সমাদর লাভ করবে লেখাগুলো।
ফ্ল্যাপে লিখা কিছু কথা 'যাবার আগে আপনি বলে যাবেন আপনি কে? আমি বললাম, 'মারিয়া আমি কেউ না।। am Nobody." আমি আমার এক জীবনে অনেককে এই কথা বলেছি-কখনো আমার গলা ধরে যায়নি, বা চোখ ভিজে ওঠেনি। দু'টো ব্যাপারই এই প্রখম ঘটল।
তারা হাঁটছে। পায়ের নিচে নদী। মাথার উপর অন্য এক রকম আকাশ। চারপাশে থৈ থৈ জোছনা। যে জোছনা মানুষকে পাল্টে দেয়। যে জোছনায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্রম হয়। লেখকের কথা আমার ইচ্ছা ছিল খুব আনন্দময় একটি গল্প লিখব। কয়েকজন যুবক চাঁদের আলোয় পথে পথে হাঁটছে, হইচই করছে এই নিয়ে গল্প। লিখতে লিখতে অন্যরকম হয়ে গেল। এই কারণেই আমি কখনও বিশেষ কোনো পরিকল্পনা মাথায় রেখে লিখতে বসি না। সব সময় দেখেছি যা লিখতে চাই তা লিখতে পারি না। যা লিখতে চাই না তা লিখে ফেলি। আমার জন্যে লেখালেখির পুরো ব্যাপারটাই কেমন এলোমেলো। হুমায়ূন আহমেদ শহীদুল্লাহ হল
প্রথম ব্যাচে যারা গিয়েছিল, তারা আগস্ট মাসের প্রথম দিনে হঠাৎ করে যুব-শিবিরটায় এসে সকলকে চমকে দিল। তাদেরকে চমকে দিয়ে কিছুক্ষণ পর অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেখান থেকে আরও সরজন চলে গেলে কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। যারা যেতে পারল না তারা আফসোসে ভরে উঠল। কারও চোখে শ্রাবনের ঢল নেমে এল। অনেক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের থেকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় তালিম নিতে ব্যাকুল হয়ে গেল। অনেকে প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের সাথে দেশের ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করল। কারণ যুব-শিবিরের অবস্থা তখন পাকি-মিলিটারীর ভয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারা একই অবস্থা দেখে আসছে দীর্ঘদিন ধরে এবং তার কোনো পরিবর্তের চিহ্ন দেখতে পায়নি। ভয়ানক বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে সর্বদা কালো মেঘের ঘনঘটা। নদীর পানির রঙ যেমন বদলেছে, তেমনি তার স্রোতের তুখোড়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। রহমান শরণার্থী-ক্যাম্পের অবস্থা জানতে গিয়ে দেখতে পায়, আগের সেই নদীটা দুকূল ছাপিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে চলে এসেছে। যেন তারও থাকার মতো কোনো আশ্রয় নেই। কালিগঙ্গা ঘোলাস্রোত নিয়ে তুখোরভাবে ছুটে চলে, সাপের মতো পাক খায়। কুণ্ডলি পাকায়। তাতে ভেসে চলে দূরবর্তী শহরের যতোসব আবর্জনা, জঞ্জাল আর মরামারীতে মৃত শরণার্থীর ফোলাপচা গলিত প্রায় লাশ। স্বাধীনতার জন্য ইতোপূর্বে এতো আত্মহুতি কী দিতে হয়েছে কোনো জাতির, ব্যাপারটা আকস্মিকভাবেই যেন ভাবিয়ে তোলে রহমানকে। দেশের ভেতরের প্রত্যেকটি বসতীতে মিলিটারি হামলা চালাচ্ছে তাদের দোসর, আলবদর-রাজাকার বাহিনীর সাহায্যে। তারা খোঁজখবর নিয়ে বিশেষ-বিশেষ গ্রাম রাতের আঁধারে ঘিরে ফেলছে। তারপর দিনের আলোয় সেখানকার প্রত্যেকটি যুবক ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করছে। নারীদের লাঞ্ছিত করছে। সর্বশেষ তাদের সম্পদ লুট করে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে তাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখছে। সেখানকার ডোবানালায় অগনিত মানুষের লাশ ভাসছে। প্রত্যেক মুহুতেই সেখানে এক বা একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে...।
"সূচীপত্র: * ছায়াসঙ্গী * শবযাত্রা * ওইজা বোর্ড * সে * দ্বিতীয়জন * বেয়ারিং চিঠি * বীণার অসুখ * কুকুর * ভয় পূর্বকথা আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন? আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আমি মজা করার জন্য প্রতিবারই বলেছি- ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি তবে মানুষ বিশ্বাস করি না। উত্তর ঠিক না। কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই। চল্লিশ বছর পার করে দিয়েছি, এখন পর্যন্ত ভূত দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই হয়নি। আমার অতিপরিচিত কেউও ভূত দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তা হলে হঠাৎ করে ভূতের গল্প লিখতে বসলাম কেন? আসলে গল্পগুলি ঠিক ভূতের নয়- অন্যরকম অভিজ্ঞতার গল্প, যে- অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই আছে এবং চট করে ব্যাখ্যা করা যায় না। উদাহরণ দিই- ছোটবেলায় মরিয়ম বলে আমাদের একটা কাজের মেয়ে ছিল। বয়স বারো-তেরো। অসম্ভব বোকা। তার ঘুম ছিল প্রবাদের মতো। বাথরুমে কাপড়ে সাবান মাখাতে মাখাতে ঘুমিয়ে পড়ত, চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এই মেয়েটা কোনো এক বিচিত্র উপায়ে ভবিষ্যৎ বলত। ঘর ঝাঁট দিতে দিতে হঠাৎ হয়েতো বলল, আইজ আমরার বাসাত বুড়া কিসিমের একটা লোক আসব, সাথে ছোট মাইয়া। লোকটার শহল্যে হইলদা জামা। সত্যি সত্যি তা-ই হতো। মরিয়ম ভবিষ্যদ্বাণী করেছে অথচ তা হয়নি এই নজির নেই। ভবিষ্যদ্বাণীগুলি কীভাবে করত তা সে নিজেও জানে না। প্রশ্ন করলে বলত- চউক্ষের সামনে দেহি। ক্যামনে দেহি জানি না। আমাদের পরিবারে একটি বড় দুর্ঘটনার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার পর এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে-অক্ষরে মিলে যাবার পর তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়। এই পৃথিবীতে যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন বিষয়ও যে ঘটে তা মরিয়মকে দেখেই আমি প্রথম বুঝতে পারি। অবিশ্যি এটা স্বীকার করে নেয়া ভালো যে- আজকের বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা করতে পারছে না আগামীদিনের বিজ্ঞান তা পারবে। হয়তো মরিয়মের ভবিষ্যৎ বলতে পারার যে-ক্ষমতাকে আমাদের কাছে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বলে মনে হচ্ছে, আসলে তা মোটেই নয়। হয়তো আগামীদিনের বিজ্ঞান সময়কে জয় করবে। তখন ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান বলে আলাদা কিছু থাকবে না। আমি লক্ষ করেছি খুব সহজে অধিকাংশ ভৌতিক অভিজ্ঞতারই লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। ছোটবেলায় আমি আমার নানুর কাছ থেকে তাঁর জীবনের একটা ভয়াবহ ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প শুনতাম। সেই সময় গল্প শুনে ভয়ে ও আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। এখন মনে হচ্ছে আমার মাতামহীর অভিজ্ঞতার একটি সহজ ব্যাখ্যা আছে, সেই ব্যাখ্যা খুব খারাপ না। আবার কিছু-কিছু গল্প এমন যে তার কোনো ব্যাখ্যাই দাঁড় করানো যায় না। আমি নানানভাবে চেষ্টা করেও কিছু পাইনি। হয়তো আমার বুদ্ধিবৃত্তি তত উন্নত নয়। এইজাতীয় ঘটনার মুখোমুখি এলে থমকে দাঁড়ানো ছাড়া পথ নেই। আমি অনেকবার থমকে দাঁড়িয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমাদের আলোকিত জগতের পাশাপাশি একটি অন্ধকার জগৎও আছে। সেই জগতের নিয়মকানুন ভিন্ন। আমি এই গল্প সংকলনে অন্ধকার জগতের কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। কিছু বাইরের গল্পও আছে, তার মালমশলা আমার অতি প্রিয়জনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য, কিংবা অন্য ভুবন সম্পর্কে কোনো ধারণা দেবার জন্যে গল্পগুলি দেখা হয়নি। লিখেছি এই পৃথিবীর রহস্যময় ব্যাপারগুলির দিকে ইঙ্গিত করার জন্য। লেখাগুলি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করার জন্যেই বলব। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ব্যাখ্যার অতীত কিছুই নেই। আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তা আমার অক্ষমতা, অন্য কেউ করবেন। হুমায়ূন আহমেদ শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়"