‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা এই বইটিতে লেখক ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে পুরো পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তী সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত সরল ও অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। লেখক নিজে ছিলেন এই সময়ের অনেক ঘটনার সাক্ষী, কিছু ঘটনায় তাঁর ছিল সরাসরি অংশগ্রহণ। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর সে অভিজ্ঞতারই বস্ত্তনিষ্ঠ বয়ান পাওয়া যায় বইটিতে। কৌতূহলী পাঠক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কাছে বহুদিন ধরেই এ বই একটি মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-আকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ বইটির একটি সুমুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
"একটি পরোক্ষ রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনগুলো দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে একটি ‘একতরফা’ এবং ২০১৮ সালে আরেকটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন হয়। যার ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পুরো প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাক্রম নিয়ে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি ও উচ্চ আদালতের ভূমিকা নিয়েও। এ বইয়ে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক বা সংকট চলছে, সেই সংকটের কারণ অনুসন্ধানের জন্য বইটি সচেতন নাগরিকদের অবশ্যপাঠ্য। "
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় জিতে ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ এম জে আকবরের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক গ্রন্থ ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করতে যাচ্ছে সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘নালন্দা’। অন্যান্য যেসব প্রকাশনা সংস্থা বইটির অনুবাদ প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের জাতির পিতা যথাক্রমে মোহনদ্াস করমচাঁদ গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের ভূমিকার ওপর তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘গান্ধী’স হিন্দুইজম: দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট জিন্নাহ’স ইসলাম’ । বইয়ের শিারোনামই বলে দেয়, লেখক অবিভক্ত ভারতের পক্ষে গান্ধীর অবস্থানকে উর্ধে তুলে ধরেছেন এবং জিন্নাহকে তুলোধূনা করতে ছাড়েননি। মানুষের সমালোচনা থেকে কেউ রক্ষা পায় না। সৃষ্টিকর্তা, তিনি আল্লাহ হোন, ইশ্বর বা ভগবান হোন -- তারাও মানুষের সমালোচনা, হাসি-মস্ক‹রার পাত্র। তাদের প্রেরিত নবী-রাসুল, অবতাররা সমালোচনার উর্ধে নন। অতএব গান্ধী ও জিন্নাহ তাদের পক্ষ-বিপক্ষের দ্বারা প্রশংসিত ও সমালোচিত হবেন, এটাই স্বত:সিদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অহরহই দেখা যায়, গতকাল যারা একজনের মাথায় ক্ষমতার রাজমুকূট পরিয়েছেন, আজ তাকে মসনদ থেকে টেনে নামাচ্ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি ভারত বিভাগ মেনে নিতে পারি না। কোনো রাষ্ট্রের কোনো বিভাজন মেনে নিতে পারি না। আমি ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে’ (ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি) বিশ্বাস করি। এটি নতুন বা আধুনিক যুগের ধারণা নয়। সূফি দার্শনিক ইবন-আল-আরাবি (১১৬৫-১২৪০) বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা দিয়েছেন, যাকে তিনি বলেছেন ‘ওয়াহদাত আল-ওয়াজুদ’ অর্থ্যাৎ ‘সত্তার ঐক্য’। অর্থ্যাৎ ‘সেই বাস্তবতা এক, আল্লাহ বা ইশ্বরের অস্তিতই একমাত্র সত্য, অন্যান্য সবকিছু ছায়া, আল্লাহ গুণাবলীর প্রতিফলন মাত্র। আল-আরাবির দর্শনকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছেন আবদ আল-করিম আল-জিলি (১৩৬৬-১৪২৪), যিনি বলেছেন, ‘আল ওয়াহদাহ ফিল-কাসরাহ ফিল-ওয়াহদাহ’ অর্থ্যাৎ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র’। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিরা আরও চমৎকারভাবে ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’কে বিশ্লেষণ করেছেন। এম জে আকবরের গ্রন্থের প্রতিপাদ্যও তাই। এই গ্রন্থে ব্রিটিশের কবল থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং মাত্র ২৪ বছর পর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তান তত্ত্বের অসারতার কথাও বলা হয়েছে। সাধারণ পাঠক ছাড়াও রাজনীতিবিদ, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষকদের অবশ্য পাঠ বই বলে আমার বিশ্বাস।
এ বই তাজউদ্দীন আহমদের কাছে লেখা ও তাঁর লেখা চিঠির সংগ্রহ। প্রথম চিঠিটি ১৯৫৩ সালের। এরপরের চিঠিগুলো ১৯৫৫, ১৯৬৬-৬৭ ও ১৯৭১ এবং তার পরবর্তী সময়ের। চিঠিগুলোর মধ্যে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমা আর একটি জাতির রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বের ইতিহাস। একাত্তরে যুদ্ধের দিনগুলোতে বিশাল দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। কর্মযোগী মানুষটির কাছে প্রতিদিন অজস্র চিঠি আসত। যুদ্ধ সংগঠনের কত বিচিত্র প্রয়োজনের কথা সেই সব চিঠিতে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা প্রতিটি চিঠি পড়ে জরুরি চিঠিগুলোর উত্তর দিতেন। সংরক্ষণ করতেন সব চিঠি। আর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠিয়ে দিতেন সংশ্লিষ্ট বিভাগে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে বিদেশে নানাজনের কাছে লিখতেন। আবার সমান গুরুত্ব দিয়ে উত্তর দিতেন ছোট্ট শিশুর চিঠিরও। চিঠিগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য দলিল।
বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতি গ্রন্থে আবদুল গাফফার চৌধুরীর ১৪৫টি লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিষয়-অনুযায়ী লেখাগুলােকে আটটি পর্বে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু, প্রসঙ্গ শেখ হাসিনা, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, স্মৃতিচারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশ্বরাজনীতি, প্রসঙ্গ করােনা ইত্যাদি। এই লেখাগুলােতে লেখকের পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত আটটি পর্ব নিয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থই প্রকাশ করা যেতাে, কিন্তু পাঠকের কথা চিন্তা করেই এক গ্রন্থে এতগুলাে বিষয়কে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিশদ আলােচনা। এ ছাড়া ‘ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি যেসব সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন সেগুলােও অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে যে-চারটি লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেই লেখাগুলােতে বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র তাে বটেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতিও উপস্থাপিত হয়েছে।