লেখক এই বইটিতে এমন এক জন ব্যাক্তিকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, যাকে বল হয় জাতীয় অধ্যাপক। তিনিই আব্দর রাজ্জাক একাধারে অর্থশাস্ত্র, রাস্ট্রবিজ্ঞান, সামাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতিসহ সকল শাখায় তার রয়েছে পান্ডিত্য। লেখক স্বশরীরে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাখে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সে সব কথা ছিলো নানান প্রেক্ষাপট এবং বিষয় ভিত্তিক। আহমদ ছপার সাথে স্যারের কথাপকোথন এবং স্যারের জ্ঞান গর্ভ আলোচনা নিয়ে উপস্থাপন হয়েছে এই বই। তৎকালিন সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার নানান অসংগতি উঠে এসেছে এই বইটিতে। আহমদ ছফা আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে ছিলেন প্রায় সাতাশ বছর। সুদীর্ঘ একটা সময়। সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক হলেও মনে হয়নি তাদের সম্পর্কটায় আদৌ কোন ফর্ম্যালিটি ছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে কাউকে গুনমুদ্ধ করে রাখা কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক পেরেছিলেন, শুধু ছফা নয়, সমসাময়িক অনেক প্রতিভাবানেরাই তাকে গুরুর আসনে আসীন করেছেন। এই মানুষটিকে বিশ্বকোষ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না, জ্ঞানের শাখায় শাখায় তার অবাধ বিচরণ। ছাত্রের মনের জানালা খুলে দেয়া শিক্ষক বুঝে এমন কাউকেই বলে। অথচ বিস্তর পড়াশোনা, অগাধ জ্ঞানী এই মানুষটি কখনও নিজে কিছু লেখেননি । আবদুর রাজ্জাক স্যার কেন লেখেননি এই ব্যাপারে ছফা ব্যাখা দিয়েছেন এভাবে, এই মানুষটি তার সমকালীনদের গন্ডি পেরিয়ে এতখানিই উপরে উঠেছিলেন যে তাদের কাতারে নেমে আসা হয়ত একটু মুশকিল হত তাঁর জন্য। আহমদ ছফা এই অসাধারন মানুষটির সান্নিধ্যের স্বাদ কিছুটা হলেও আমাদের কাছে পৌছে দিতে চেয়েছেন এই বইটির মধ্য দিয়ে। দুজন অসম বয়সী বন্ধুর টুকরো টুকরো আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ বলে একে মেনে নিতেও আমার আপত্তি নেই। আবদুর রাজ্জাক স্যার বই পড়া প্রসঙ্গে খুব দারুন একটা কথা বলেছেন, “পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর্যা নিবেন , আপনের পড়া অয় নাই।”
"জয়জয়ন্তী বইটির প্রথমের কিছু অংশ: আমি ঘুরে-ফিরে একটা স্বপ্নই দেখি মামুন এবং আমি পাশাপাশি একটা রিকশা করে যাচ্ছি। রিকশার চাকার সঙ্গে কি করে যেন শাড়ি পেঁচিয়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বলছি- রিকশা থামাতে বল, রিকশা থামাতে বল। মামুন চিৎকার করছে এই রিকশা, থাম থাম। কিন্তু রিকশাওয়ালা কিছুই শুনছে না সে সমানে প্যাডেল করে যাচ্ছে। আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে। একজন ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত রিকশা থামাবার জন্য ছুটে আসছে... স্বপ্নের এই জায়গায় আমি জেগে উঠি। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। পানির পিপাসা হয়। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেক সময় লাগে। বিছানায় চুপচাপ বসে হাঁপাতে থাকি। এই সময় বাবা এসে আমার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন, কি হয়েছে রে মা? কি হয়েছে? বাবার ঘর দোতলার শেষ মাথায়। রাতে তার ঘুম হয় না বললেই হয়। তিনি সামান্য শব্দেই চটি পায়ে বের হয়ে আসেন। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে যে শব্দ করি তা নিশ্চয়ই সামান্য না। আমার পাশের ঘরে বাবলু ঘুমায়। তার ঘুম অবশ্যি কখনো ভাঙে না। আমার মত সেও দুঃস্বপ্ন দেখে। তার দুঃস্বপ্নগুলি বিকট এবং বারবার। সে বিশ্রী ধরনের গোঙানির শব্দ করতে থাকে, হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। আমি নিজেই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ি। বাবা ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন কি হয়েছে? এই বাবলু, এই। দরজা খোল, দরজা খোল। বাবর দুঃস্বপ্নগুলি সহজে ভাঙে না। সে গো গো শব্দ করতে থাকে এবং বিছানায় নড়াচড়া করতে থাকে। এক একবার মনে হয়, বিছানা থেকে গড়িয়ে বোধহয় মেঝেতে পড়ে যাবে। বাবা ভয় পেয়ে আমাকে ডাকেন রাত্রি! রাত্রি মা। আমি বাবার পাশে দাঁড়াই। দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাতে থাকি। এক সময় বাবলুর ঘুম ভাঙে কিন্তু চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসে না কারণ সে কঁপা গলায় ডাকতে থাকে মা। মা। বাতি জ্বালাও মা। তার মনে থাকে না যে মা মারা গেছেন আট বছর আগে। ছেলের দুঃস্বপ্নের সময় তিনি এসে বাতি জ্বালাতে পারবেন না। বাবা ব্যস্ত হয়ে ডাকেন ও বাবলু! বাবলু।
ভূমিকা উপন্যাসটি দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। দৈনিক কাগজে প্রকাশিত উপন্যাস কেউ পড়েন বলে আমার ধারণা ছিল না। কাজেই যা মনে আসত লিখে ফেলতাম। বুধবারে কপি দিতে হয়, আমি শেষ মুহূর্তে (মঙ্গলবার) কাগজ কলম নিয়ে বসতাম-যেভাবেই হোক ন'টি স্লীপ লিখে ফেলতে হবে। কাহিনী কোথায় যাবে এ নিয়ে ভাববার সময় নেই। এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই উপন্যাসে আমি নিজের কথাই বলতে শুরু করেছি। সব লেখাতেই লেখক খানিকটা ধরা দেন কিন্তু এরকম নির্লজ্জভাবে দেন না। বই আকারে লেখাটি প্রকাশ করবার সময় তাই খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছি। সে-সব পাঠক-পাঠিকা খবরের কাগজে 'দূরে কোথায় প্রথম পড়েছেন তাঁদেরকে বিনীতভাবে বলতে চাই বইয়ের কাহিনী কাগজে প্রকাশিত কাহিনীর চেয়ে অনেকখানিই আলাদা। অনেক অংশই নতুন করে লিখেছি, প্রচুর কাটছাঁট করেছি তবু মনে হচ্ছে আরেকবার যদি গোড়া থেকে লিখতে পারতাম ভাল হত। হুমায়ূন আহমেদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠ অবদান বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জনে সাহসী ও বীরােচিত নেতৃত্ব দান এবং এই রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন। অতীতে বহুভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই উজ্জ্বলতম কীর্তিকর্ম নিয়ে। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম তাঁর রচিত বঙ্গবন্ধু: সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য গ্রন্থে ভিন্ন ধরনের বর্ণনাভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে চিহ্নিত করেছেন। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ১৫ টি প্রবন্ধের মধ্যে লেখকের নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে উজ্জ্বল জাতির পিতার ব্যতিক্রমী দার্শনিক ব্যক্তিত্বের পরিচয় যেমন দিয়েছেন তেমনি সংবিধানে প্রতিফলিত জাতির পিতার দর্শন-স্বপ্ন, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অবস্থান, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণার বিষয়টি গণপরিষদ ও সংবিধানে কীভাবে গৃহীত হয় সে সম্পর্কে পর্যালােচনা স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। সেই সাথে আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এবং তাঁর সংসদ জীবনের শেষ দিনের বর্ণনাও প্রদত্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঘাতক কর্তৃক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তার হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। এই বইয়ের লেখক শৈশবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষদর্শী ও স্নেহধন্য। তাঁর পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সহযাত্রী ও অনুসারী। লেখক সেই অলিখিত ইতিহাসকে প্রকাশ করেছেন এই গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন-আদর্শ-চিন্তার বিভিন্ন জানা-অজানা দিক উন্মােচন হয়েছে। সে বিচারে গ্রন্থটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। গ্রন্থটি পাঠে পাঠক সমৃদ্ধ হবে।
"সব রোগে ওষুধের প্রয়োজন নেই"বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: নিয়তি বা অদৃষ্ট সম্পর্কে চীনে প্রচলিত একটি ধারণা নিয়ে দুয়েকটি কথা বলে প্রসঙ্গ কথা শেষ করব। এই ধারণাটি অন্ধবিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির সুপ্তশক্তির সাথে এর সম্পর্ক। মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ হলো নিয়তির পরিপূর্ণতা প্রদান করা, এমন একটি বোধশক্তির উদ্ভাবন করা, যার মাধ্যমে আমার নিজেদের চিনতে পারি। এই কাজটি করতে পারলে আমরা ভালো থাকব, আমাদের প্রেরণাশক্তি উদ্দীপিত ও উৎসারিত হবে এবং আমরা এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হবো যা আগে আমাদের কোনো সময় ছিল না। অন্যদিকে আমাদের চলার পথে ভয়-ভীতি, দুশ্চিন্তা বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে যদি কোনো বাধা আসে, আমাদের প্রেরণাশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে বা লোপ পাবে এবং ফলশ্রুতিতে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ব। সুতরাং রোগ- বিমারিকে জয় করার জন্য আমাদের মনোবল, প্রতিরোধ ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণাশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। তবেই শুধু সুস্থ থাকার যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারব। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা লাভ অন্যতম। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরবিদ্যার কারণে মানুষ অনেক রোগ-ব্যাধিকে জয় করতে পেরেছে ও গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিকালে দেখা যাচ্ছে যে, ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের কারণে মানবদেহে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেয়া দেওয়ার ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা চিন্তিত। আলোচ্য বইটতে লেখক ওষুধ, ওষুধের প্রয়োগ ও অন্যান্য বিষয়ে সুচিন্তিতভাবে আলোচনা করেছেন, যা যে কোনো স্বাস্থ্যসচেতন পাঠককে এ-বিষয়ে নতুন ধারণা লাভে সহায়ক হবে।