স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথে প্রধানতম ঘটনার একটি ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। তাঁকে কেন্দ্র করেই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়েই শেরে বাংলার কাছে প্রেরিত কিছু রাজনৈতিক চিঠি, টেলিগ্রাম এবং নির্বাচনের সময় প্রার্থী নির্বাচনের জন্য গঠিত ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কিছু গোপনীয় প্রতিবেদন উদ্ধার হলো। পাশাপাশি খুঁজে পাওয়া গেলো যুক্তফ্রন্টের মনোনীত অঞ্চলভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা এবং সেই নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ছাপানো কিছু লিফলেট। এগুলো ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের দালিলিক প্রমাণ। যে চিঠিপত্র শেরে বাংলার কাছে এসেছে সেগুলো সবই নির্বাচনকেন্দ্রিক। প্রাপ্ত চিঠি, টেলিগ্রাম, রিপোর্ট এবং লিফলেটের বিষয় ছিল যুক্তফ্রন্টের নেতাকর্মীদের উপর মুসলিম লীগ এবং প্রশাসনের অত্যাচার, প্রচার-প্রচারণা, এলাকায় প্রার্থীদের অবস্থা, প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য পার্টির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য, প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য ইত্যাদি। অর্থাৎ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে যেসকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল প্রাপ্ত কাগজপত্রগুলো সেসবের দালিলিক প্রমাণ। এ সব কিছু যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা ও ভাবার সুযোগ করে দেবে। তাছাড়া এসব গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের গুরুত্ব কেবল নতুন তথ্য লাভের জন্য নয়, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে ঘিরে যেসব স্মৃতিকথা কিংবা ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে সেসবের প্রামাণ্যতা নির্ণয়ের জন্য প্রাপ্ত চিঠিপত্রসহ সংযুক্ত নথিগুলো প্রয়োজনীয় উৎস।
একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে ঐ দেশের সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের অবদান থাকে, সকলের অবদানেই তো জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের অংশ গ্রহণের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে এদেশের আদিবাসীরাও। অত্যাচার-নির্যাতনের দিক থেকেও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা কোন অংশে কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জাতির পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সনাতন সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সমরদক্ষ পাকিস্তানী সেনাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে বাঙালি ছাড়াও অর্ধ-শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ- সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, গারো, হাজং প্রভৃতি; অসংখ্য আদিবাসী নারী-পুরুষ এদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছে প্রত্যক্ষভাবে।
মানবিক অনুভূতিগুলোকে অবিভাজ্য রেখে দেশে দেশে সীমানা বিভাজিত হয়। এই বিভাজনের খেলার ক্রীড়ক ও ক্রীড়নক থাকে মানুষ নিজে। যুগে যুগে মানুষের ইশারাতেই মানুষের রক্ত ঝরে, ভূখ-ের সীমানা নির্ধারিত হয়, দেশের প্রান্তসীমায় কাঁটাতার বসে, এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে ঠাঁই নেয় মানুষ। দেশ ছাড়া আর দেশ হারা যেভাবেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন এই মানুষগুলোর হাহাকার যেন জলের রেখা ছাড়া আঁকা যায় না।
প্রখ্যাত রাজনীতিক আতাউর রহমান খান বাংলার ইতিহাসে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি রচনাকর্মের জন্যও সমাদৃত। তাঁর রচনায় ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক গুণসমৃদ্ধ। তিনি ইতিহাসের বিশ্বস্ত বয়ান উপস্থাপন করেন সরল ভাষায় কিন্তু চিন্তার গভীরতায়। অবরুদ্ধ নয় মাস তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালের স্মৃতিচারণ। এই বই যেমন আতাউর রহমান খানের জীবনের একটি পর্ব ধারণ করেছে, একই সঙ্গে জাতীয় ইতিহাসের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। মহান একাত্তরের বহু অজানা তথ্য এই স্মৃতিচারণে পাওয়া যাবে যা মুক্তিযুদ্ধের সত্যসন্ধ ইতিহাস নির্মাণেও ভূমিকা রাখবে।
আমার এই মুক্তিযুদ্ধ ফিরে দেখা গ্রন্থের নেপথ্যে উৎসাহ জুগিয়েছেন সহধর্মিণী সুলতানা নাদীরা বেগম নাজনীন এবং দুই মেয়ে নাদিয়া ইসলাম ও নিতিয়া ইসলাম। এদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী ইমরুল চৌধুরী। তাঁদের উৎসাহে স্মৃতি নির্ভরশীল ঘটনাবহুল বই রচনায় সাহস পেয়েছি। এই বই ৬৬৮২২টি শব্দমালায় রচিত। চল্লিশ বছর পেছনের ঐতিহাসিক ঘটনা দিনের পর দিন চর্চা, গর্ব, অহংকারের সুরক্ষায় যেন একটি টাটকা স্মৃতি হয়ে গেছে। 'ঐতিহ্য' সৃজনশীল প্রকাশনায় বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে এর প্রধান নির্বাহী জনাব আরিফুর রহমান নাইমের গভীর আগ্রহে ও উৎসাহে বইটি লেখায় আত্মনিয়োগ করি এবং তাঁরই প্রচেষ্টার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত আরও একটি দলিল হিসেবে বইটি প্রকাশ পেল। এর জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ ও তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। এ ছাড়া ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার সাবেক সিনিয়র সহকর্মী বাংলাদেশ বেতারের প্রাক্তন পরিচালক ও নাট্যকার কাজী মাহমুদুর রহমানের-তাঁর আন্তরিক সহযোগিতার জন্য।