গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে কেন পাকিস্তান একটি একক রাষ্ট্র ছিল না, ১৯৭০-এর নির্বাচন কোন সংকট সৃষ্টি করে এবং কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান তার চরম সংকট সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, দখলকৃত বাংলাদেশে তারা নয় মাস কী কী প্রচেষ্টা নেয়, পরিস্থিতি সামলাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ক্রিয়াকর্ম, যা শেষে ব্যর্থ হয় এসবের আলোচনা। এ ছাড়া আছে কীভাবে পাকিস্তানের কার্যক্রম মিডিয়াতে এসেছে, হামুদুর রহমান কমিশনের মূল বক্তব্য, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভ,মিকা নিয়ে তদন্ত করে পাকিস্তান সরকার তার রিপোর্ট এবং সেই সময়ের প্রতিবাদী পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকার। শেষে রয়েছে নির্বাচিত প্রামাণিক দলিল ও নয় মাসের ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের জয় পরাজয় বইটির রচনাগুলিতে চোখ ফেললেই বোঝা যায়, এ দেশের জনসাধারণ নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুক্তির জন্যে মরণপণ যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের সেই মুক্তি ঘটেনি। স্বাধীনতার স্বাদ এ দেশের কল্যাণকামী জনগণ পায়নি। কারণ যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলা হয়, সেই দলেরই হাতে এ দেশের মানুষের প্রায় সমস্ত আকাক্সক্ষা দলিত ও ধূলিসাৎ হয়েছে। বইটির পরতে পরতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনব্যবস্থা এ দেশের জনগণের দুশমনেরই কাণ্ডকারখানা। মানুষকে পঙ্গু করে রাখার সব ধরনের আয়োজন কায়েম করে রাখা হয়েছে এখানে। এ ব্যাপারে অন্ধ থাকলে চলবে না- এটাই এ বইয়ের আসল কথা।
১৯৭১: অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ গ্রন্থটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার প্রথম প্রহরের ওপরে নির্মিত। বহুকাল আগে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার চরমপর্বের ঘটনাবলি বিন্যস্ত করে এই গ্রন্থটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের একাধিক পর্ব রয়েছে। যার মধ্যে চরমপর্ব হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলে সামরিক শক্তি দিয়ে নির্মিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতা উন্মোচিত হয়। এ প্রকারের রাষ্ট্র যে আর টিকতে পারবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। পাক আর্মির অস্তিত্বের জন্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এমন একটি সংকট তৈরি করে, যা সমাধানযোগ্য ছিল না। এটাকে সামলাতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মি সংসদ মুলতবি ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী রুখে দাঁড়ায় অর্থাৎ এ পর্যায় থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চরমপর্ব শুরু হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রতিরোধের প্রথম পর্যায় শেষ হয় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। পরবর্তীতে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জাতীয় যুদ্ধে লিপ্ত হন। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করা। এই গ্রন্থে পহেলা মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত যে অসহযোগ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সেটাকে তথ্য ও দলিলের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। নিরস্ত্র পর্ব অর্থাৎ পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এবং সশস্ত্র পর্বটি ২৫ মার্চ রাতের পর থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত। এরমধ্যে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। তারপর পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত করার জাতীয় যুদ্ধ শুরু হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে যে ক'জন গুণী মানুষ একক প্রচেষ্টায় গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে বিমূর্ত করার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অন্যতম লেখক ও গবেষক সালেক খোকন। সাধারণের আড়ালে থেকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা তুলে আনার ক্ষেত্রে তিনি বহু বছর ধরে নিয়োজিত। নিভৃতচারী লেখক নিরলস প্রচেষ্টায় আমাদের 'গৌরব ও বেদনার' মহান মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত মানুষের কথা তুলে আনার ব্রতী হয়েছেন, যাঁরা ছিলেন অন্তরালে। '১৯৭১: যাঁদের ত্যাগে এলো স্বাধীনতা' গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে অজান্তেই। ১৯৭১ সালে বাংলার জমিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের বীরত্বগাঁথা নিজ বয়ানে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিবরণ গ্রন্থটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। গ্রন্থভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস বিনির্মাণে লেখকের যে পবিত্র চেষ্টা অব্যাহত আছে, তাতে এ গ্রন্থ নিঃসন্দেহে গতি আনবে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে। গ্রন্থটিতে লেখক সুনিপুন মুন্সিয়ানায় আমাদের গৌরবের মহান একাত্তরকে বাস্তবতার পটভূমিতেই রেখে সত্য আবহ দিতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের নিজ বর্ণনায় তৎকালীন প্রেক্ষাপটের তথ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দলিল ও আলোকচিত্র উঠে এসেছে, যা নিঃসন্দেহে আগামী ও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার, নারী মুক্তিযোদ্ধার বিপুল সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর ইতিহাস অনেকটাই উপেক্ষিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে দেশবাসী তেমন করে জানেনই না। এই অনালোকিত অন্ধকার জগতে আলো ফেলে ইতিহাসের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাসমনস্ক করতে এবং আমাদের ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হবে পরিশ্রমী গবেষণায় লেখা বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা' গ্রন্থটি।
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী সিভিল সোসাইটির নানাবিধ কর্মতৎপরতায় সজীব ছিল। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে এই কর্মতৎপরতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের নানা প্রান্তের কার্টুনিস্টরা তাদের কার্টুনে ফুটিয়ে তুলে ছিলেন একাত্তরের অস্থির ও উত্তাল সময়, পাশাপাশি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ও গণহত্যার বিপক্ষে তাদের অবস্থানও। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে, জনগণের মনে প্রত্যাশা তৈরিতে ও জনমত গঠনে এই কার্টুনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত কার্টুনগুলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে এসব কার্টুন সংগৃহীত হয়েছে।