একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিকথা প্রচুর লেখা হয়েছে। কিন্তু দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাহাত্তরের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ বিশেষ পাওয়া যায় না। একটি বড় যুদ্ধ ও রক্তপাতের পর এ দেশের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠভাবে জানা যাবে শওকত ওসমানের এই স্মৃতিলিপি থেকে। তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথাও লিখেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টাই তিনি ছিলেন ভারতে, কলকাতায়। সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের জীবনযাপন কাছে থেকে দেখেছেন তাদের অনেকের আচার-আচরণ সম্পর্কে কৌতুহলােদ্দীপক বিবরণ রয়েছে এ বইয়ে।
সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যের বিচারে হাসান আজিজুল হক এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং বিরলদৃষ্ট প্রতিভা। তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মতো ছোটগল্প আর আগুনপাখির মতো উপন্যাস তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। তরুণ গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মাসউদ আহমাদ ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে কিছু নিবিড় সময় কাটিয়েছেন। সে সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও স্মৃতিধর্মী রচনা। এই প্রথম এগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কালপর্বের সৃষ্টিসম্ভারের মূল্যায়ন যেমন বইটিতে আছে, তেমনি আছে সমকালীন সাহিত্যের সমস্যা নিয়ে পর্যবেক্ষণও। আছে লেখকের জীবনস্মৃতি ও নিজের লেখা নিয়ে অন্তরঙ্গ আলাপ। বাদ যায়নি সমাজ সমস্যার আলোচনাও। এসব বিষয়ে হাসান আজিজুল হকের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে এই বইয়ের অন্তভুর্ক্ত নানা স্বাদের রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। ভাষাশহীদ বরকত মারা যান তাঁর চোখের সামনে। হাসপাতালে দেখেছিলেন রফিকের খুলি উড়ে যাওয়া লাশ। তিনি তখন আর্ট কলেজের ছাত্র। মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন। মনে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন। ভাষা আন্দোলন হয়ে উঠল তাঁর আজীবনের প্রেরণা। পরের বছর হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে প্রধান দুই রেখাচিত্রশিল্পীর একজন। সেই থেকে শুরু। এ বই ভাষা আন্দোলন নিয়ে মুর্তজা বশীরের স্মৃতি ও স্বপ্নভরা লেখা এবং শিল্পকলার সমারোহ।
কবি-সাহিত্যিকেরা বেশির ভাগই মজার মানুষ। হুমায়ূন আহমেদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কিংবা নির্মলেন্দু গুণের রসবোধের কোনো তুলনা হয় না। তাঁদের রসিকতাগুলো দেশবিখ্যাত এবং চিরন্তন আনন্দ ও শিক্ষার উত্স। আবার রসবোধে খ্যাতি তেমন নেই, এমন মানুষও ঘটিয়ে থাকেন মজার মজার ঘটনা। শুধু মজার ঘটনা তো নয়, লেখক-কবিদের জীবনে ঘটে অনেক দুঃখের ঘটনা; আর সারাক্ষণই তাঁদের পোড়াতে থাকে শিল্পের আগুন। সমকালীন সাহিত্যের অনেক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিককে কাছে কিংবা দূর থেকে দেখেছেন আনিসুল হক। লেখকদের নিয়ে আনিসুল হকের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, কৌতুক, আনন্দ-বেদনা আর হাহাকারের গল্পগুলো ধরা থাকল এই বইয়ে। এই লেখাগুলো একই সঙ্গে স্মৃতিচারণা, সাহিত্যের উদ্যাপন, লেখকদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং সাহিত্যিক মূল্যায়নের রেখাচিত্র।
অভিজাত পরিবারে জন্মেছিলেন কল্যাণী রায়। বাবা ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। কল্যাণী ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করেছিলেন, নাম বদলে হয়েছিলেন মমতাজ বেগম। তাঁর রায়বাহাদুর বাবা বিয়েটা মেনে নেননি। ফলে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর। দেশভাগের পর শিশুকন্যাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই নিজ স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে সরকারের রোষানলে পড়ে জেলে যেতে হয় তাঁকে। স্বামীর কথামতো দাসখত দিয়ে কারামুক্ত হতে চাননি। কারাগারে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গে একই সেলে ছিলেন মমতাজ। এই কারাবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনদৃষ্টি ও চেতনাকে এমনভাবে গড়ে দেয় যে ৪৪ বছরের আয়ুর বাকি দিনগুলো তিনি ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টির কল্যাণব্রতে উৎসর্গ করেছিলেন। মমতাজ বেগমের জীবনে রয়েছে একই সঙ্গে এপিকের বিস্তার ও গভীরতা। তাঁর সেই অসাধারণ জীবন নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটিকে আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবময় সময়ের দলিলও বলা যায়।