১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকাল ৪:৩০ মিনিটে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে। অন্যদিকে আমরা তখন ভোলার চরফ্যাশনে নিভৃত এক পল্লীতে। সেখানেই আমরা দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়ে আনন্দ উল্লাস করি। সারা দুনিয়ার মানুষ তখন জানল বিশ্বে একটা নতুন দেশ জন্মের কথা। সে দেশের নাম বাংলাদেশ। এখন আমার জীবনের বিজয় কখন আসবে? সেকথা কে বলতে পারবে? আমি মনে মনে এ প্রশ্নটি করি,কিন্তু প্রকাশ করি না কারো কাছে। নয় মাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারত এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদেরকে অজস্র সাহায্য করেছে। চরফ্যাশনের এক পল্লীতে আমি তখন কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছি।
"অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ১৯৭১। আজ ৪০ বছর পর এই তিনটি শব্দ দু-তিন জেনারেশনের কাছে অর্থহীন। কিন্তু আমরা যারা এখন পৌঢ় বা বৃদ্ধ, তখন ছিলাম যুবক বা মধ্য বয়সী, তাদের কাছে এই তিনটি শব্দের অর্থ ভয়, হত্যা, লুট, গ্রেপ্তার, ধর্ষণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম অবরুদ্ধ হয় ঢাকা শহর। প্রথম এক সপ্তাহ, প্রতিদিন রাতে দেখা যেত লেলিহান আগুনের শিখা আর শোনা যেত গুলির শব্দ। সকালে দেখা যেত ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ। কারফিউ তো বলবত্ ছিলই, কিন্তু যখনই একটু শিথিল হতো, তখনই দেখা যেত রাজপথ ভরে উঠছে মানুষে। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। খোঁজ করছে আত্মীয়স্বজনের। আবার কারফিউ, আগুন, গুলি।"
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নীলগঞ্জে হঠাৎ পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর আগমন, বাংলাদেশের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতার আভাস দিয়েছেন লেখক। ছোট্ট পরিসরের উপন্যাসে উত্তাল রণাঙ্গনের বর্ণনা নেই। আছে গ্রামের নিরীহ বাঙালিদের অসহায়তা। উপন্যাস শেষে পাকিস্তানি মেজরের বাঙালি সহকারীর উক্তি "রফিক তীক্ষ্মস্বরে বলল- মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এ দেশ থেকে।" লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়ে গেছে।
পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চে তখন তিনটি প্রধান পক্ষ—আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি এবং সেনাবাহিনী। আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা প্রবেশ করেছিলাম একটা রক্তাক্ত অধ্যায়ে। এই বইয়ে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ-পর্বের একটা ছবি এঁকেছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম স্বাভাবিকভাবে হয়নি। একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র, তা-ও আবার আপসে নয়, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন উদাহরণ বিরল। বাংলাদেশের ঠিকুজি খুঁজতে গেলে আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এই বইয়ে আছে দলটির ওই সময়ের পথচলার বিবরণ, যখন দেশ একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধ ছিল বাঙালির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের অনিবার্য গন্তব্য। আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা একটা রক্তাক্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছিলাম। আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ওই পর্বের একটা ছবি আঁকা হয়েছে এই বইয়ে।