একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই ছিলেন বন্ধু ; শত্রুও ছিলেন কেউ কেউ। এই বন্ধু ও শত্রুর তালিকায় রয়েছে নানা বিদেশি রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। রণাঙ্গনের বাইরে তাঁরা সক্রিয় ছিলেন কখনো প্রকাশ্যে, কখনো পর্দার আড়ালে। মুক্তিযুদ্ধে সব বন্ধুর কথা যেমন সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়নি, সব শত্রুর কথাও তেমনি ঠিক ঠিক জানা হয়নি। সেসব জানা-অজানা কথা দলিল-দস্তাবেজ, বইপত্র ঘেঁটে লেখক তুলে এনেছেন এ বইয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছায়াবলম্বনে দুটি ভিন্ন স্বাদের বড়ো গল্প। উভয় গল্পের পটভূমি একাত্তর, যদিও ঘটনার প্রকাশ বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। গল্পচ্ছলে এখানে প্রকাশিত হয়েছে একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকার অন্তরঙ্গ চিত্র। সঙ্গে থাকল অধরা প্রেমের স্মৃতিভেজা এক আখ্যান।
১৯৬৪ সালে দাঙ্গার শিকার হয়ে সপরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানস। জন্মভূমির প্রতি জন্মেছিল ঘৃণা, মুছে দিতে চেয়েছিল তার সব স্মৃতি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সে নিউইয়র্কে, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। সেখানে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় এই নিজের জন্মভূমির ভাগ্য নিয়ে বৃহৎ শক্তিসমূহের দড়ি-টানাটানি। নিজের অজ্ঞাতেই সে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে দেশটির মুক্তি আন্দোলনে। উপলব্ধি করে রাজনীতি ও মানচিত্রের বিভেদে ছিটকে পড়লেও জন্মভূমির সঙ্গে তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। ভাঙতে থাকে মানবিক সম্পর্কের ভুল-বোঝাবুঝি। আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় রচিত হাসান ফেরদৌসের প্রথম উপন্যাস মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই এক প্রামাণিক কাহিনি।
পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সর্বাত্মক বিরোধিতা করে। অপর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। কোনো কোনো গবেষকের দাবি, মস্কোর এই সমর্থন তার নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে। স্বল্প পরিচিত ও অজ্ঞাত অসংখ্য নথিপত্র ও সমসাময়িক কূটনীতিকদের স্মৃতিচারণার ভিত্তিতে লেখক এ বইয়ে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক, এমনকি নৈতিক দায়িত্ববোধ দ্বারাই চালিত হয়েছিল সোভিয়েতের সমর্থন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের নাটকীয় অধ্যায়, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক অস্ত্রসংবলিত সপ্তম নৌবহর প্রেরণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কূটচালের ব্যর্থতা—এই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাক্রমের প্রামাণিক বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে এ বইয়ে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটিতে হলেও সে যুদ্ধের আড়ালে রয়েছে অনেক যুদ্ধ যা সংঘটিত হয় বাংলার মাটি থেকে দূরে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অথচ কত জানা-অজানা মানুষ সে যুদ্ধে আমাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে। এই গ্রন্থে রয়েছে সেই সব কিছু জানা-অজানা মানুষের কথা। রয়েছে সেই যুদ্ধের পেছনে যুদ্ধের কিছু কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে, জানুয়ারি ১৯৭১-এ একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাকের কাহিনি দিয়ে এই গ্রন্থের শুরু। আমরা সেই হাইজ্যাকের কথা অনেকেই মনে রাখিনি, কিন্তু সমর কৌশলবিদেরা একমত, সেই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এছাড়াও রয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে সােভিয়েত কূটনীতিক ইয়াকভ মালিকের সাহসী ভূমিকার বিবরণ, বাংলাদেশের গণহত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডের প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি, একাত্তরের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের একটি সাক্ষ্যভাষ্য ও মার্কিন নৌ-বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ অবরােধের অবিশ্বাস্য কাহিনী।