একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আলোড়িত করেছিল বিশ্বেরআঃনানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষকে, দূর দেশে বসবাসরত বাঙালিদের অন্যতর জীবনেও এই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা সচষ্টে হয়েছেন সময়ের ডাকে সাড়া দিতে, মুক্তিসংগ্রামের পড়্গে যথাসাধ্য ভূমিকা পালনে। বিশ শতকের সত্তরের দশকের সেই সূচনাকালে প্রবাসী বাঙালিরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিলেন না, কিনত্মু তাদের ভূমিকা কতভাবেই না ফলপ্রসূ হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই কীর্তিগাথা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হলেও সেসব মূলত যৌথ নাগরিক উদ্যোগের বিবরণী তুলে ধরেছে, ব্যক্তি-মানুষের পরিচয় সেখানে বিশেষ মেলে না। এই গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে এমনি দুই ব্যক্তির ভিন্নতর ভূমিকার কথা, একজন সুনীল দাশগুপ্ত, দেশভাগের পূর্বেই যিনি দেশত্যাগ করে উদ্বাসত্মু জীবন বরণ করেছিলেন, পরে স্থিত হয়েছিলেন তত্কালীন পূর্ব জার্মানিতে, আরেকজন মোশাররফ হোসেন, পাকিসত্মান সরকারের বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে। একাত্তরে তাদের ভূমিকার ব্যক্তিগত অনত্মরঙ্গ চিত্র এঁকেছেন নাজমুন নেসা পিয়ারি, জার্মানিতে সমপ্রচার-মাধ্যমে দীর্ঘকাল কাজ করে কৃতির স্বাড়্গর যিনি রেখেছেন। রাষ্ট্র ও ভেৌগোলিক বিভাজন ও দূরত্ব অতিক্রম করে মানবসত্তার যে অসীম আকাশে সর্বজনের মিলন ঘটে সেই তাড়না একেবারে বাসত্মব কর্মকাণ্ডে মূর্ত হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় মিলবে এই গ্রন্থে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিঘাত ও প্রতিরোধের একেবারে আলাদা এক ছবি, যা পাঠকের সামনে মেলে ধরবে মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতার অনত্মরঙ্গ ও অন্যতর হৃদয়ছোঁয়া ভাষ্য।
"রাজাকারের কর্মকাণ্ড" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় চার দশকের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণার সূত্রে তাজুল মোহাম্মদ ঘুরেছেন জনপদ থেকে জনপদে, আহরণ করেছেন মাঠ পর্যায়ের তথ্য, দীর্ঘ দিনের একনিষ্ঠ ইতিহাস-চর্চায় তিনি নিজেকে বিশিষ্ট করে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন গোটা দেশের বাস্তবতার ছবি তার চিত্তপটে যেমনভাবে উদ্ভাসিত হয়, তেমন আর কারো ক্ষেত্রে বলা যাবে না। একাত্তরে পাকবাহিনীর সহযোগী-গোষ্ঠী, যারা বহু নির্মমতা ও নৃশংসতার জন্য দায়ী, রাজাকার অভিধায় সাধারণভাবে পরিচিত, তাদের দেশব্যাপী কর্মকাণ্ডের খোজ তাজুল মোহাম্মদের মতো করে আর কেউ রাখেন না। ফলে তাজুল মোহাম্মদের রাজাকারের কর্মকাণ্ড গ্রন্থ কোনো অঞ্চল বা কতক ঘটনার বিবরণ কেবল নয়, একাত্তরে নয় মাস জুড়ে সারা দেশে যেসব নৃশংসতা ঘটিয়েছে পাকবাহিনীর সহযোগীরা তার সুনির্বাচিত ভাষ্য এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য গবেষক স্বয়ং জেনেছেন প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা শহীদের নিকটজনের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে, সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ফলে ইতিহাসের ঘটনা শুধু নয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়েছে এই গ্রন্থ, সেইসাথে নিছক বর্ণনা নয়, হয়েছে মানবতার দলিল।
পর্বত-কন্যা কাকন বিবি সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের একজন, জীবনের চলার পথে তাঁকে বহু বাধা বিঘ্ন মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। পার্বত্য জাতিসত্তার সদস্য হিসেবে রূপ-লাবণ্যে তিনি অনেকের দৃষ্টি কেড়েছেন, আবার দরিদ্র অবহেলিত নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কালো থাবা তাঁর দিকে প্রসারিত হয়েছে বারবার। বিচিত্র তাঁর জীবন-কথা, তার চেয়েও কঠিন তাঁর জীবন-যুদ্ধ। নির্যাতিত হয়েছেন একাত্তরে, যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, শত্রু শিবিরে প্রবেশ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে, আবার মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর হারিয়ে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেক বিলম্বে হলেও এক সময় উদ্ভাসিত হয় তাঁর বীরত্ব-গাথা, সংবর্ধিত হন তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান রাষ্ট্রের তরফ থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পান ঊষ্ণ ভালোবাসা। অখ্যাত অজ্ঞাত এই বীর নারীর জীবন-ভাষ্য রচনা করেছেন একনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। কঠিন সেই দায়িত্ব দক্ষতা ও মমতার সাথে পালন করেছেন তিনি। কাকন বিবির জীবনের পূর্বাপর এই বয়ান তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের আলোড়িত করবে নিশ্চয়, সেই সঙ্গে আলোকিতও।