সত্য গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর-মার্ক টোয়েনের এই বিখ্যাত উক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। এই ভূখণ্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রধান মাইলফলক মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ দেশের মানুষকে বদলে দিয়েছে আমূল, নড়বড়ে করে দিয়েছে এ অঞ্চলের সামাজিক বুনন ও রাজনীতির চালচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে দিয়েছে রাজনীতির ব্যাকরণ। বলা চলে, একরকম শূন্যতার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদের অন্য একধরনের প্রবণতা, যার সংগঠিত রূপ হচ্ছে জাসদ নামের একটি রাজনৈতিক দল। দলটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের উপজাত ফসল এবং একই সঙ্গে দ্রোহের চরমতম প্রতীক। এই বইয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে দলটির উত্থান, বিস্তার ও ভেসে যাওয়ার কাহিনি, যা উপন্যাসকেও হার মানায়। সে কাহিনিতে স্বপ্ন আছে, রোমাঞ্চ আছে, আছে নাটকীয়তা ও বীরত্ব। সব মিলিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী অস্থির সময়ের এক দলিল, যার অনেকটাই লেখা হয়েছে রক্তের অক্ষরে।
চট্টগ্রাম সফরকালে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়া এবং এর পরপরই আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেপ্তার ও নির্মম হত্যার ঘটনা এ বইয়ের মূল বিষয়। জিয়া হত্যার দায়ে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের রায়ে যাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, কেবল তাঁরাই কি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন? সাত্তার সরকারের গঠিত সেনা ও বিচার বিভাগীয় তদন্তে কি প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছিল? জেনারেল মঞ্জুর কি আসলেই চট্টগ্রামের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? নাকি ষড়যন্ত্রের শিকড় ছিল আরও গভীরে? আমাদের কাছে ইতিহাসের এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের অনেক কিছুই আজও অনুদ্ঘাটিত। ঘটনার সময় এ বইয়ের লেখক ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। কাছ থেকে অনেক কিছু জানার, অনুসরণ করার সুযোগ হয় তাঁর। লেখকের অভিজ্ঞতার বিবরণসংবলিত এ বই অনুসন্ধানের নতুন জানালা খুলে দেবে।
১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অস্থির সময়। বাকশাল গঠন, সেনা অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর সপরিবার নির্মমভাবে নিহত হওয়া, নভেম্বরে আবার সামরিক অভ্যুত্থান, জাতীয় চার নেতার হত্যা, পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান—সব মিলিয়ে বছরটি ছিল বাংলাদেশের একটি গভীর সংকটের কাল। এত অল্প সময়ে এত সব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক। কিন্তু কোথাও এই সময়ের একটি পুরো চিত্র পাওয়া যায় না। এ বইয়ে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও মতামত তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্গে আছে দেশি ও বিদেশি নানা দলিল। সংশ্লিষ্টদের জবানবন্দি, সাক্ষাৎকার ও কাছ থেকে দেখা ব্যক্তিদের স্মৃতিকথা হিসেবে লেখাগুলো বহু সময় ধরে বহু চেষ্টায় সংগ্রহ করা হয়েছে। পঁচাত্তরের অস্থির সময়ের পুরো চিত্র তুলে ধরেছে এ বই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় ইতিহাসের শোকাবহ রক্তরঞ্জিত দিন। দেশের পরবর্তী ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী। সে সম্পর্কে বিশদ তথ্যাদি আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি। ১৫ আগস্টের ঘটনার পূর্বাভাস দেশি-বিদেশি কোনো সূত্রে পাওয়া গিয়েছিল কি না, বঙ্গবন্ধু নিজে সে সম্পর্কে কতটা অবহিত ছিলেন কিংবা তিনি বিষয়টিকে কীভাবে নিয়েছিলেন—সাংবাদিক, কূটনীতিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের রচনা ও সাক্ষাৎকার থেকে তা আজ ক্রমপ্রকাশমান। বইটিতে সংকলিত স্মৃতিকথা, দলিল ও গবেষণাধর্মী রচনার মাধ্যমে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও পূর্বাপর ঘটনাসম্পর্কিত তথ্য এবং সত্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটবে। আগস্ট ট্র্যাজেডি সম্পর্কে মতামত ও বিশ্লেষণধর্মী রচনা এ বইকে অমূল্য করেছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি হয়েছিল, “রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে।" যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বহু লালিত স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিপ্লব' কর্মসূচির মাধ্যমে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত কার্যকরী মাধ্যম ছিল জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি মাত্র রাজনৈতিক দল 'বাকশাল'। জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক কর্মসূচিকে ঈন্সিত লক্ষাভিমুখী দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু 'বাকশাল' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাকশালের মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা; যা ছিল জনগণের যুগ যুগের লালিত স্বপ্নের মহত্তম আকাঙ্ক্ষার গৌরবময় বহিঃপ্রকাশ। বাকশাল কর্মসূচিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এক. রাজনৈতিক, দুই আর্থ-সামাজিক, তিন, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা —এই বইটিতে যার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের পূর্বে ও পরে পার্লামেন্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা এবং গণভবনে জেলা গভর্নর ও বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই ভাষণগুলোর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং এতে নিহিত বাকশাল কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে বইটিতে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, যাতে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে দেশ অগ্রসর হতে না। পারে। এই বইটিতে ইতিহাসের সেই অধ্যায়কেই পাঠকের নিকট তুলে ধরা হয়েছে, যা পনেরোই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্ত হয়েছে।