আবেদীন কাদেরের প্রবন্ধ যেমন কবিতায় আর্দ্র তেমনি শব্দঝংকারে প্রসাদগুণ সম্পন্ন। তাই বলে কবিতাগুণ তাঁর রচনাকে ভাব থেকে বিচ্যুত করে না মোটে। লেখক হিসেবে তিনি একেবারে ঠিক স্বল্পপ্রজ নন; যদিও বই প্রকাশে তাঁকে স্বল্লোদ্যমই বলা যায়। মাঝে কয়েক বছরের বিদ্যায়তনিক উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যস্ততা গ্রন্থোদ্যম থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল! তাঁর লেখার অন্তর্বস্তু তত্ত্বের অনুকূল কিন্তু স্বাদ কথাসাহিত্যিকতায় রসঘন। পূর্বপ্রকাশিত প্রবন্ধ-সংকলন দ্বীপান্তরের গান বিদেশি সাহিত্যের আনন্দ সন্ধান হলে বড় বেদনার মতো বেজেছ যেন ব্যক্তি ও তাঁদের কীর্তির অর্কেস্ট্রা। এরই ধারাবাহিকতায় এই শ্রাবণের বুকের মাঝে ব্যক্তির কর্মধারার বর্ণিল ঝর্ণা। পাণ্ডিত্য তথা তত্ত্ব তাঁর বহু সাধনায় অধীত সামগ্রী যা পরিকীর্ণ হয়ে আছে এই বইয়ের রচনারাজির চরণে, অন্তর্বয়নে। এই বই পড়লে পাঠকের মনে উপলব্ধ হবে প্রবন্ধের দার্শনিকতা কিন্তু উপভোগ্য হবে কথাসাহিত্যের রসধারা।
কোনো কোনো গল্পের শুরু থাকে না, সমাপ্তিও নেই। কারো কারো জীবনের মতো বলা নেই কওয়া নেই সময়টা ঝরে পড়ে। কেউ কেউ আবার এদের নাম রেখেছেন আদর করে 'ঝুরো গল্প'। সবখানেই মানুষের ভিড় থাকে তবুও মানুষ একলা মানুষ। ভিড়ের মাঝেই মিশে যেতে যেতে মানুষ আরও একাকী হয়, শূন্যে মিলিয়ে যায়। একার ভিড়ে সে কি ভাবে? ক. কোনো মানুষ যদি নিজেকে কষ্ট দেয়, সেটা থেকে তাকে বের করে আনবার উপায় কি? খ. কেউ যদি কাউকে মিস করে সেটা সে তাকে যথার্থ বোঝাবে কী করে? গ. মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে সহজ উপায় কী? ভুল জিনিস চিন্তা করা বন্ধের উপায়? কাউকে ভুল না বোঝার উপায়? কাউকে বিশ্বাস করার পন্থা কী? ঘ. পজিটিভ কিছুকে পজিটিভ ভাবার ক্ষমতা কীভাবে গ্রো করে? হয়তো এর কিছুই ভাবে না। এ রকম ছোট ছোট কিছু গল্পের সম্মেলন এই 'একার ভিড়ে একা। পড়তে পড়তে থমকে গিয়ে হয়তো ভাবতে পারেন এ তো আমারই গল্প। আর সেই একাত্মতাটুকু যদি না হয়, তবুও ভেবে নিন না যে; আমিও একার ভিড়ে একা।
চারদিকে বসন্তের হাওয়া বইছে। আশপাশের বাড়িগুলােতে টিউলিপ ফুটছে। মেপল গাছের কচিপাতাগুলাে সবে গজাতে শুরু করেছে। বিকেল হতেই ছেলেপুলেরা রােলার স্কেট নিয়ে গলির রাস্তায় খেলতে নামছে। এরকম একটা দিনে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ডাফিস-ড্রাইভ-ইন আইরিশ পাবের লােকগুলাে চেনা আহ্লাদে দুলতে থাকে। দেখে মনে হতে পারে যে ওরা কাঁদছে। কিন্তু আলেহান্দ্রো বােঝাতে চেষ্টা করে যে, ওটা হাসি, কান্না নয়। মানুষের হাসিও। এমন হয়? আলেহান্দ্রো মেক্সিকান খাবারের দোকান ছাড়া অন্য কোথাও সচরাচর তেমন একটা যায় না। আজই প্রথম কী মনে করে যেন সে একটা আইরিশ পাবে নিয়ে এলাে আমাকে। সন্ধ্যা ঘন হবার আগেই উঠোন ঝাড়ু দিয়ে, ময়লার বিনগুলাে সরিয়ে, ঝাউয়ের পাতাগুলাে হেঁটে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আলেহান্দ্রোর সাথে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। আমরা দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে উড়ে এসে উত্তর আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজে’ পরিচিত হয়েছি। ওর সঙ্গে আমার পছন্দের যেমন কেনাে মিল নেই, তেমনি। সম্পর্কের ব্যাপারেও আমাদের কোনাে আগ্রহ নেই। আমাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কটিকে কিছুটা বন্ধুত্ব' অথবা কিছুটা পরিচিত' বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে ভাষার প্রতি ওর আগ্রহ অপরিসীম। মােট পাঁচটি ভাষায় সে ভাঙা ভাঙা কথা বলতে পারে। তার মধ্যে বাংলা একটি। | পাবে ঢুকতেই বাইরের ফুরফুরে হাওয়াটা হঠাৎ সরে গেল। একটা কটু গন্ধ নাকে এসে লাগলাে। চারদিকে সবাই কথা বলছে। কাঁটা চামচ, প্লেট গ্লাস আর কথার শব্দ গমগমে সুরের মূর্ধনা তৈরি করেছে। আধাে-আলােয় শরীরগুলাে এদিক ওদিক মাতাল ছায়ার মতন নড়ছে। কিন্তু মানুষ কই? যেন কতগুলাে জানােয়ার বসে আছে। শেয়ালের চেহারার লােকটা একটা বিয়ারের ক্যান নিয়ে বসে টেলিভিশনে হকি খেলা দেখছে। শুকরের মতাে দেখতে চারটা লােক পাশের টেবিলে বসে তাস খেলছে। ওদের চেহারায় দ্রতার ছিটেফোটা নেই। অথচ এদের কেউই কোনাে চেচামেচি বা অভদ্র আচরণ করছে না।
তখন আমার শহর জুড়ে রাত্রির নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সকল নীরবতা ভেঙে আপনি আবার কথা বলতে শুরু করলেন, সেই একই গল্প। আপনার ভীষণ একা লাগে। কোথাও শান্তি মেলে না। কোথাও স্বস্তি মেলে না। কথাগুলো শুনে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে মানুষের মন সবসময় আশ্রয় খুঁজে ফেরে। কেউ আশ্রয় পায়। আর কারো পাওয়া হয় না। তবুও এই শহরের রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ও একটি কথা বলা হয় না, আপনি, আমি, আমরা সবাই একা।
জীবনের প্রয়োজনে মানুষ দেশান্তরী হয়। কঠোর সংগ্রাম করে সচ্ছল জীবন খুঁজে নেয়। নিজের জন্যে ও দেশে রেখে আসা পরিবার, স্বজনের জন্যে। যে কোনও প্রাপ্তির পেছেনে হারানোর গল্প থাকে। থাকে হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস। শেকড় ছেড়ে আসা মানুষেরা প্রতিনিয়ত শেকড়ে ফেরার স্বপ্ন লালন করে বুকের গহীন কোণে। ভাবে, একদিন দেশে ফিরে যাব। অবশ্যই ফিরে যাব। কিন্তু ফেরা কি হয়? 'অনন্ত গোধূলির ছায়া' গ্রন্থের প্রতিটি গল্প দেশ ও প্রবাসের কঠিন বাস্তবতার কথা বলে। বুকের ভেতরে পুষে রাখা স্বপ্নের ও দীর্ঘশ্বাসের কথা বলে। জীবন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবার কথা বলে। এক কথায় বলা চলে গল্পগুলো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।