"...তারপর আসে ২৬ মার্চের সেই দুঃসহ প্রভাত। ভীষণ অনিশ্চয়তার একটি দিন। সেদিনের মতো এতটা রক্তমাখা সূর্যোদয় হয়তো কখনো দেখেনি এ দেশের মানুষ। তবু এ এক নতুন ভোর। নতুন সূর্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। এমন এক স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের দিনে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এক সীমাহীন মৃত্যু ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে শুরু হয়েছিল এর সম্প্রচার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র! ছোট্ট একটি নাম। কিন্তু কী দুর্বিনীত শক্তি ছিল এই নামের। স্বাধীনতার আজ এত বছর পর সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এই কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র অনেকে অশ্রু ধরে রাখতে পারেনি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের। গৌরবের। গভীর আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ানোর। বাঙালির মনন জগতে সেদিন আলোড়ন তুলেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সবার হৃদয় গেঁথেছিল একসূত্রে। দুর্বার সাহস দেখিয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর। এই বেতার থেকে ভেসে আসা বাণীতে ছিল মুক্তির আশা। ভয়াবহ দুঃসময়। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালি। তাদের মনোবল রাখতে হবে অক্ষুণ্ণ। ঠিক তখনই আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এর এক একটি শব্দে যেন জেগে উঠেছিল বাংলার এক একটি জনপদ..."
আমাদের জন্মগল্পের উপাখ্যান। কোন দূর গ্রামের এক নারী একদা তাড়া খেয়ে ফিরছিল, ফেলে যাচ্ছিল তার ভিটে-মাটিকে, কোলে ছ'মাসের সন্তান। নদী-খাল পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। তার এখন গল্প শুধু সময়ের সাথে, তাঁর এখন গল্প শুধু নিজের সাথে। পাশ দিয়ে ওর মতই আরো নারী-শিশুরা হাঁটছে, হাঁটছে, কারো হাতে ছোট পোটলা, কোন কিশোরীর হাতে আহত হয়ে যাওয়া বিড়াল ছানা অথবা শালিক পাখির বাচ্চা। লেখিকা ফিরে গিয়েছেন একাত্তরের সেই ভয়ংকর সময়ে। গল্পের গাঁথুনিতে গড়ে তুলেছেন এক একটি সত্য ঘটনাকে, দিয়েছেন বুনন। আমরা চলে গিয়েছি কখনো ত্রিপুরায়, কখনো পুরান ঢাকার নারিন্দা বাজারে, নইলে বুড়িগঙ্গার ওপারে কামরঙ্গির চর হয়ে আবারো বিলেতের রাস্তায় কোন হিউম্যানিস্টের মিছিলে। এ শব্দমালা কোন গল্প নয়, নয় কোন রোমান্সের পঙক্তিমালা। এ বাক্যের সারিরা ইতিহাস, আমাদের জন্মের ইতিহাস, আমাদের মায়ের গর্ভাশয়ের ইতিহাস।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগ, ১৯৫২-এ ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এ মহা মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা যেমন আছে প্রচুর, গল্পও আছে প্রচুর। মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই দেশের সাহিত্যিকেরা সাহিত্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্যে এসেছে নতুন একটি মোড়। নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় আমাদের সাহিত্যিকদের। সেই অভিজ্ঞতালব্ধ মুক্তিযুদ্ধ পটভূমিতে লেখা এমন কয়েকটি গল্প নিয়ে এই সংকলন। সংকলনের গল্পগুলো আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, সেই সাথে আমাদের লাল সবুজ পতাকা চিরকালের জন্য সমন্নত রাখবে এই আশা রাখি। আনিসুজ্জামান কাজল