"গ্রামের একাত্তর ইতিহাসকে স্মৃতিবদ্ধ করার নতুন ধরনের একটি প্রকল্প। মূলধারার ইতিহাস চর্চা অনেক বেশি দলিলপত্র নির্ভর, গ্রাম সেখানে নিতান্তই প্রান্তিক। অথচ সিংহভাগ মানুষ ছিলেন গ্রামেরই বাসিন্দা, শহর থেকেও বিপুল মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রামে। আফসান চৌধুরী সম্পাদিত গ্রামের একাত্তর গ্রন্থে গ্রামজীবনের আলেখ্যগুলোকেই কেন্দ্রীয় পটভূমি হিসেবে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এই ইতিহাস চর্চার মূল উপাদান মানুষের স্মৃতি। একাত্তরের চরম পরিস্থিতি মানুষের অন্তর্গত চরমতম প্রবণতাগুলিকেও প্রবল করেছিল। মানুষ যেমন ভিনদেশী শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে, তেমনি মুখোমুখি হয়েছে তার চিরচেনা প্রতিবেশীরও। স্থবির অর্থনীতি আর উত্তুঙ্গ সংগ্রামের সেই মুহূর্তগুলি জনমানুষের জন্য খুব সহজ ছিল না। প্রতিরোধের বীরত্ব সেখানে যেমন ছিল, তেমনি ছিল আপোষে অভিযোজনের অজস্র ঘটনা। গ্রামের মানুষ অজস্র কৌশলে আত্মরক্ষা করেছিল, কী করে তারা ধর্মপালন করতো, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ধরন কেমন ছিল তার খণ্ড খণ্ড যে চিত্র আফসান চৌধুরী ধারণ করেছেন, তা আতঙ্কের সেই শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে আজকের পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে। গবেষকের সতর্ক নজর এড়ায়নি ১৯৭১-এ লালনের মাজারের ভক্তদের মনোভাব থেকে শুরু করে যানবাহনের অভাবে মানুষের হাঁটার পরিমাণ বৃদ্ধি অথবা সুদী কারবারের চলনের মতো সূক্ষ্ম বিষয়ও। ইতিহাসবিদ বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতি ধরে রাখার একটা যুদ্ধ চালিয়ে যান। দলিল-দস্তাবেজের বাইরে জনস্মৃতিও যে ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, আফসান চৌধুরীর গ্রামের একাত্তর সেই সত্যটিকে আরও একবার প্রতিষ্ঠিত করেছে।"
"যে-কোনো যুদ্ধই যুদ্ধাক্রান্ত জনপদের নারীদের জন্য দুঃসহ সময় নিয়ে আসে। উনিশশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও নিরাপত্তাহীনতা ছিল নারীর জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস্তবতা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে নিপীড়িত হওয়াই নারীর একমাত্র অভিজ্ঞতা নয়। নারী নিজে হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অশ্রয় দিয়েছেন, আহত যোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন, নিজের সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন এবং এমন সব ঝুঁকি নিয়েছেন, যা স্বাভাবিক সময়ে কল্পনারও অতীত। প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী নারীর বয়ানে নারীদের একাত্তর বইয়ে আফসান চৌধুরী হাজির করেছেন যুদ্ধদিনে নারী-জনগোষ্ঠীর অসহনীয় ক্লেশ আর অতুলনীয় সংগ্রামের চিত্র। বইটি দেখায়- নারীরা কেমন করে নানাবিধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অক্লান্তভাবে যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করে গেছেন। যুদ্ধে নিপীড়িত নারীদের অনেকেই যুদ্ধের পরেও সামাজিক ঘৃণা, বঞ্চনার শিকার হয়েও পর্বতের মতো অটল থেকেছেন, হয়েছেন অপরাজেয়। মুক্তিযুদ্ধে নারীর সংগ্রামের বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতাকে তুলে আনা আফসান চৌধুরী সম্পাদিত নারীদের একাত্তর গ্রন্থটির বিশেষত্ব।"
"উনিশশ একাত্তর সালে এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। গণহত্যার মুখে শরণার্থী হিসেবে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের বড় অংশটিই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দেশের মাঝে যারা আটকা পড়েছিলেন, বা থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদেরও হত্যা, ধর্ষণ, আঘাত, লুটতরাজ এবং বন্দিত্বসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। একাত্তরে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে যে নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তার একটা প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর গ্রন্থে। পাকিস্তানের কাছে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল ‘ভারতীয়’। তাই হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের ধরন এবং মাত্রার তীব্রতার পেছনে কাজ করেছিল পাকিস্তানকে নিরাপদ করার বাসনা। একাত্তর সালে হিন্দু জনগোষ্ঠী কেন বিশেষভাবে হানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো, তার সংক্ষিপ্ত একটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি আফসান চৌধুরী তার ভূমিকাতে প্রদান করেছেন। শরণার্থী শিবিরে দিন কাটানো, ধর্ষণের শিকার কিংবা প্রিয়জনকে নিহত হতে দেখা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে না পারা হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর-এর এই বিবরণ পুরোটাই কেবল নৃশংসতা আর নিষ্ঠুরতার শিকার হবার বিবরণ নয়। এখানে আছে হিন্দু-মুসলমান সহৃদয়তার, ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেশীকে রক্ষার অজস্র সাক্ষ্য, আছে প্রতিরোধ এবং সহমর্মিতার গল্পও। হিন্দুদের একাত্তর মূলত মাঠ পর্যায়ের গবেষণার ফল। নির্যাতিত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এই স্মৃতিগুলোকে বর্তমান গ্রন্থে ধরে রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অন্যত্র প্রকাশিত কিছু রচনা। গ্রাম ও শহরে একাত্তরের চিত্র আরও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝতে আফসান চৌধুরীর দীর্ঘ জীবনের গবেষণার আর একটি অর্জন হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর; এর আগে ইউপিএল প্রকাশ করেছে তার গ্রামের একাত্তর (ঢাকা: ইউপিএল,২০১৯)। একাত্তর সালের গ্রাম ও শহরের নানা পেশা ও শ্রেণির হিন্দু জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার এই বিবরণ মুক্তিযুদ্ধের চিত্রটিকে আরেকটু সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পাঠককে সহায়তা করবে।"